আর্কাইভ থেকে ইউরোপ

গ্রীনল্যান্ডে বিরল বৃষ্টিপাত!

গ্রীনল্যান্ডে বিরল বৃষ্টিপাত!

চলতি মাসেই সারা বছর বরফে মোড়ানো থাকা গ্রীনল্যান্ডে বিরল বৃষ্টিপাতের ঘটনা ঘটেছে। গ্রীনল্যান্ডের বরফের চূড়ায় প্রথমবারের মতো বৃষ্টিপাত হয়েছে। এটি জলবায়ু পরিবর্তন ও বিপর্যয়ের একটি উদ্বেগজনক মাইলফলক বলছেন বিজ্ঞানীরা। তারা জানিয়েছে, টানা কয়েক ঘণ্টা এমন বৃষ্টিপাতের অভিজ্ঞতা তাদের আগে কখনো হয়নি। সাধারণত ১০ হাজার ৫৫১ ফুট ওপরে তাপমাত্রা ফ্রিজিংয়েরও নিচে থাকে। তাই এই মৌসুমে বৃষ্টিপাতকে অস্বাভাবিক হিসেবে দেখছে বিজ্ঞানীরা।

বিজ্ঞানবিষয়ক সাময়িকী সায়েন্সঅ্যালার্ট জানিয়েছে, ইউনিভার্সিটি অব কলোরাডোর ন্যাশনাল আইস অ্যান্ড স্নো সেন্টারের বিজ্ঞানী টেড স্ক্যাম্বোস বলেছেন, গ্রীনল্যান্ডে বৃষ্টিপাত শুধু যে এক বা দুই দশকের জলবায়ু পরিবর্তনের ফল, তা নয়। এমন ঘটনা শত বছরেও বিরল। পৃথিবীবাসী বায়ুমন্ডলকে যেভাবে দূষিত করছে তা এখনই বন্ধ না করলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক তো হবেই না, উল্টো আরও ভয়াবহতার দিকে যাবে। গ্রীনল্যান্ডে গেল মাসেও আশঙ্কাজনকহারে বরফ গলেছে। ২০২১ সালের গ্রীষ্মে সবচেয়ে বেশি বরফ গলেছে এ অঞ্চলে।

যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল স্নো অ্যান্ড আইস ডাটা সেন্টারের বিজ্ঞানীরা বলছে, সারা বছর বরফে ঢেকে থাকা গ্রীনল্যান্ডে ফ্রিজিং টেম্পারেচারের বেশি তাপমাত্রাই উঠে খুব কম। সেখানে এখন বৃষ্টিপাতের এক বিরল রেকর্ড হয়েছে। গড় তাপমাত্রার চেয়ে কয়েক গুণ বেড়ে যাওয়ায় এই বৃষ্টিপাত হয়েছে।

গেল ১৪ থেকে ১৬ আগস্ট টানা তিনদিনের বৃষ্টিপাতে প্রায় ৭শ’ কোটি টন পানি ঝরেছে বরফের চূড়ায়। ১৯৫০ সাল থেকে গ্রীনল্যান্ডের আবহাওয়ার তথ্য রেকর্ড শুরুর পর এটিই প্রথম বৃষ্টির ঘটনা। অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাত এটাই প্রমাণ করে, গ্রীনল্যান্ডের তাপমাত্রা ক্রমেই বাড়ছে। গেল জুলাইয়ে ডেনমার্কের এক বিজ্ঞানী জানিয়েছিলেন, সেখানে প্রতিদিন ৮শ’ কোটি টন বরফ গলে যাচ্ছে।

এর আগে এই মেরু অঞ্চলে ২০১৯, ২০১২ আর ১৯৯৫ সালে অনেক বরফ গলেছিল। ১৪ থেকে ১৬ আগস্টের বরফ গলা আর বৃষ্টির পরিমাণ অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। বাতাসের তাপমাত্রা বাড়ায় বরফও গলছে, বৃষ্টিপাতও হচ্ছে। অঞ্চলটি ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়তে যাচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল স্নো অ্যান্ড আইস ডাটা সেন্টারের বিজ্ঞানী ওয়াল্ট মেয়ার বলেন, বৃষ্টিপাতের এমন ঘটনা গ্রীনল্যান্ডে আগে কখনো ঘটেনি। অন্যান্য জায়গায় ১ ডিগ্রি তাপমাত্রা বাড়লে কারও চোখেও পড়বে না। কিন্তু এখানে তাপমাত্রা বৃদ্ধির ঘটনা ভয়ানক কিছুর পূর্বাভাস দেয়। হয়তো সামনে আরও বড় তাপপ্রবাহ, দাবানলের মতো কোন দুর্যোগ অপেক্ষা করছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহতা পুরো পৃথিবীকে ঋতুবৈচিত্র্য থেকে বঞ্চিত করছে। প্রকৃতি একটু একটু করে স্বাভাবিক বৈচিত্র্য হারাচ্ছে। বৃষ্টির মৌসুমে প্রচন্ড খরা, বন্যা মৌসুমের আগেই বন্যা, কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই ঝড়সহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপর্যস্ত পুরো পৃথিবী। এর মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিদিনই নতুন কোনো গুরুতর চমক দিচ্ছে। গ্রীনল্যান্ডের এই বৃষ্টি জলবায়ু পরিবর্তনের আরেকটি সতর্ক বার্তা।

যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশনের সামিট স্টেশন জানায়, গেল ১৪ আগস্ট থেকে বৃষ্টি হচ্ছে গ্রীনল্যান্ডে। এই মৌসুমে এতো বৃষ্টিপাত কখনোই হয়নি। পুরো গ্রীনল্যান্ডে বৃষ্টির মাধ্যমে ৭০০ কোটি টন পানি মেঘ থেকে পড়েছে। এ সময় সেখানে গ্রীষ্ম মৌসুম চলছে। সেখানকার বেশিরভাগ স্থানের তাপমাত্রা ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি। সাধারণত এ সময় গ্রীনল্যান্ডের বেশিরভাগ অঞ্চলের বরফ গলে যায়। বৃষ্টির কারণে এবার পানির পরিমাণ অনেক বেশি হয়েছে। গ্রীনল্যান্ডকে ব্রিটেনের চার গুণ বড় মনে হচ্ছে।

সাম্প্রতিক সময়ে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে জাতিসংঘের প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা গেছে, মানুষের কার্বন নিঃসরণ প্রতিদিন পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়াচ্ছে। উষ্ণায়ণের কারণে বিভিন্ন স্থানে বরফ আগের তুলনায় অনেক দ্রুতগতিতে গলে যাচ্ছে।

বিজ্ঞানীরা বলছে, গ্রীনল্যান্ডের বরফ এখন আশঙ্কাজনক অবস্থায় আছে। পৃথিবীর তাপমাত্রা যদি বাড়তেই থাকে বরফ গলে পুরোপুরি পানি হতে বেশিদিন সময় লাগবে না। এরই মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে গেছে ২০ সেন্টিমিটার।

জাতিসংঘের কোড রেড ফর হিউম্যানিটি প্রতিবেদন বলছে, চলতি শতকের শেষে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়বে ১০০ সেন্টিমিটার। পৃথিবীর তাপমাত্রা পূর্বাভাসের চেয়ে বেশি বাড়লে ২০০ সেন্টিমিটারও হতে পারে। ২০১৯ সালে ১০ লাখ টন বরফ হারিয়েছে গ্রীনল্যান্ড। জুলাইতে যে পরিমাণ বরফ গলেছে এর পানি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের পুরোটাই ২ ইঞ্চি ঢেকে ফেলা যাবে।

গ্রীনল্যান্ডের সব বরফ গলে গেলে পৃথিবীর সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৬ মিটার বেড়ে যাবে। যদিও বরফ গলতে শত বছর সময় লাগবে। কিন্তু ১৯৯৪ সাল থেকে এখন পর্যন্ত লাখ কোটি টন বরফ গলে গেছে, যা ক্রমাগত সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়িয়ে চলেছে। এতে পৃথিবীর উপকূলীয় এলাকাগুলো সমুদ্রে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা বাড়ছেই।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে চীনে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত ও বন্যা, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ কয়েকটি দেশে ভয়ানক দাবানল ও তাপপ্রবাহের পর আরও গ্রীনল্যান্ডে বৃষ্টির ঘটনাও নতুন এক রেকর্ড। তবে কি আশঙ্কাজনকভাবে গলতে থাকা বরফে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে কয়েকটি দেশ তলিয়ে যাওয়ার বিজ্ঞানীদের পূর্বাভাসই সত্যি হতে যাচ্ছে!

চলতি বছরের জানুয়ারিতে এক গবেষণায় বলা হয়, গ্রীনল্যান্ডের বরফ গলতে থাকলে ২১ শতক নাগাদ পৃথিবীতে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা ১৮ সেন্টিমিটার বাড়বে। যা কয়েকটি দেশ তলিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ঠ।

 

এসএন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন গ্রীনল্যান্ডে | বিরল | বৃষ্টিপাত