বাংলাদেশের সবচেয়ে দীর্ঘতম রেলওয়ে সেতু পাকশী হার্ডিঞ্জ ব্রিজ। ১০৮ বছরের পুরনো এই রেলসেতুটি অবস্থিত পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার পাকশীতে । ব্রিটিশ স্থাপত্য শিল্পের এক অনন্য নিদর্শন হার্ডিঞ্জ ব্রিজ। শতবর্ষের সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে বীরদর্পে।
যুগের পর যুগ চলে গেছে, কত শাসক-শোষক আর প্রজন্মের সাক্ষী হয়ে রয়েছে এই ব্রিজটি। শতবছর পেরিয়ে গেছে, কিন্তু হার্ডিঞ্জ ব্রিজ প্রমত্ত পদ্মার বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে এখনও। এখন পদ্মার সেই যৌবন ফুরিয়ে গেছে। সেই উত্তাল ঢেউ নেই, কুলকুল রব তুলে ছুটে চলা পদ্মা এখন যেন বার্ধক্যে উপনীত হয়েছে। কিন্তু ঠিকই পদ্মার বুকে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ যেন যৌবনের জয়গান গেয়ে যাচ্ছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে যেন এই ব্রিজের যৌবন রয়েই গেছে । একদিকে যেমন সৌন্দর্য, অপরদিকে ইতিহাসের সাক্ষী- সব মিলিয়ে এই ব্রিজটি বাংলার ঐতিহ্য এবং তাৎপর্য বহন করছে। এর অপর প্রান্তে রয়েছে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলা।
এই ব্রিজটি এককভাবে বাংলাদেশের বৃহত্তম ইস্পাত নির্মিত ডুয়েল গেজ রেলওয়ে ব্রিজ। ব্রিজটির দৈর্ঘ্য ১,৭৯৮.৩২ মিটার বা ৫,৮৯৪ ফুট (১.৮ কি.মি)। সর্বমোট ১৫টি গার্ডার বা স্প্যান রয়েছে। প্রতিটি স্প্যানের দৈর্ঘ্য প্রায় ১২০ মিটার করে প্রতিটি স্প্যানের ওজন এক হাজার দুইশত পঁঞ্চাশ টন। ২৪ হাজার ৪০০ শ্রমিক-কর্মচারীর পাঁচ বছর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল এই ব্রিজ। এসব শ্রমিকের অধিকাংশই ছিল বাঙালী। ব্রিজের ওপর দুটি ব্রডগেজ রেললাইন রয়েছে। পাশে চলাচলের রাস্তা ও রয়েছে।
১৯০৮ সালে ব্রিজ নির্মাণের মঞ্জুরি পাওয়ার পর ব্রিটিশ প্রকৌশলী স্যার রবার্ট উইলিয়াম গেইলস হার্ডিঞ্জ ব্রিজ নির্মাণের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। প্রধান প্রকৌশলী রবার্ট শুধু ব্রিজের নকশা প্রণয়ন করেন। ব্রিজের প্রথম প্রকল্প প্রণয়ন করেন স্যার এস এম রেলডলস। এই ব্রিজে রয়েছে ১৫টি মূল স্প্যান। মূল স্প্যান ছাড়াও দুপাশে রয়েছে তিনটি করে অতিরিক্ত ল্যান্ড স্প্যান। তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের ভাইসরয় লর্ড ব্যারন হার্ডিঞ্জের নাম অনুসারে এই ব্রিজটির নামকরণ করা হয়।
কয়েক দশক পূর্বে প্রস্তাব করা হলেও ব্রিজটির নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১৯১০ সালে। ১৮৮৯ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার কলকাতার সাথে আসাম, নাগাল্যান্ড, ত্রিপুরা ও উত্তরবঙ্গের নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। এজন্য সর্বপ্রথম ১৮৮৯ সালে ব্রিজটি নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়।
পরবর্তীতে দীর্ঘ ১৯ বছর পর ব্রিজটি নির্মাণের জন্য মঞ্জুরী লাভ করে। ব্রিজটি নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া হয় ব্রিটিশ প্রকৌশলী স্যার রবার্ট উইলিয়াম গেইলসকে। ব্রিটিশ সরকার তাকে এই ব্রিজ নির্মাণের স্বীকৃতি স্বরুপ 'স্যার' উপাধিতে ভূষিত করে।
বিখ্যাত ব্রিটিশ স্থপতি আলেকজান্ডার মেয়াডোস রেন্ডেল ব্রিজটির নকশা প্রণয়ন করেন। ব্রিজটির নির্মাণের দায়িত্ব গ্রহণ করে ব্রেথওয়েইট অ্যান্ড কার্ক নামক ব্রিটিশ কনস্ট্রাকশন কোম্পানি।
১৯০৯ সালে ব্রিজ নির্মাণের জন্য সার্ভে শুরু হয়। তখন পদ্মা ছিল ভরা যৌবনা। রবার্ট উইলিয়াম গেইলস বুঝতে পারেন- ব্রিজের নির্মাণ তার জন্য অনেক চ্যালেঞ্জিং হবে। এজন্য তিনি সিদ্ধান্ত নেন মূল ব্রিজ নির্মাণের কাজ শুরু করার আগেই নদী-রক্ষা বাঁধ তৈরি করতে হবে। ১৯১০-১১ সালের পুরোটা সময় জুড়ে শুধু বাঁধ নির্মাণ করা হয়।
এক্ষেত্রে গেইলস এক অসাধারণ পদ্ধতি ব্যবহার করেন। তিনি বৃহৎ আকৃতির পাথর আর মাটি একত্রে মিশিয়ে নদীর পাড়ে ফেলতে থাকেন। দুই পাড়ে প্রায় পনের কিলোমিটার জুড়ে এভাবে বাঁধ দেন।
ধারণা করা হয়, নদী বাঁধতে যে পাথর ব্যবহার হয়েছে তা দিয়ে আরো কয়েকটি ব্রিজ নির্মাণ করা যেত। গেইলসের সেই পদ্ধতি সত্যিই কাজে লেগেছিল। একশ আট বছর পেরিয়ে গেছে, কিন্তু সেই বাঁধ এখনও সম্পূর্ণ অক্ষত আছে। যেন একটা পাথরও এখনও খুলে পড়েনি।
১৯১২ সালে ব্রিজটির মূল অংশের কাজ শুরু হয়। এ সময় ব্রিজটির গাইড ব্যাংক নির্মাণের পাশাপাশি গার্ডার নির্মাণের কাজও শুরু হয়। সেতুটি নির্মাণের ক্ষেত্রে ব্রিটিশরা তৎকালীন সর্বোচ্চ প্রযুক্তির ব্যবহার করে।
সে সময় অনেক ব্রিটিশ নাগরিকের জন্য পাকশীতে গড়ে তোলা হয় বাংলো বাড়ি ও কটেজ। পাকশীতে তখন ব্রিটিশদের অবাধ চলাচল ছিল।
রবার্ট উইলিয়াম গেইলসের একটি বড় বাংলো ছিল, যা বলা হয়ে থাকে, প্রায় এক কিলোমিটার দূরের এই বাংলো থেকে তিনি দূরবীন দিয়ে নির্মাণ কাজের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতেন।
নির্মাণ কাজের সময় পাকশী ও এর আশেপাশে ছোটখাট অনেক কলকারখানা, দোকানপাট ও বাজারঘাট গড়ে ওঠে। জনজীবনে প্রভাব পড়েছিল ব্রিটিশ অধিপত্যের। স্থানীয় মানুষের জীবনযাত্রার মান পরিবর্তন হয়েছিল। হার্ডিঞ্জ ব্রিজের উপর দিয়ে চলাচলকারী প্রথম ট্রেন দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে নির্মাণকাজ চলে। অবশেষে ১৯১৫ সালে নির্মাণকাজ শেষ হয়। ব্রিজটির নির্মাণকাজে তৎকালীন হিসেবে ব্যয় হয়েছিল ৩ কোটি ৫১ লক্ষ ৩২ হাজার ১'শ ৬৪ ভারতীয় রুপি।
১৯১৫ সালের ১ জানুয়ারি প্রথম পরীক্ষামুলকভাবে ট্রেন ঈশ্বরদী থেকে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের উপর দিয়ে খুলনা অভিমুখে যাত্রা করে। এরপর একই বছর ৪ঠা মার্চ লর্ড ব্যারন হার্ডিঞ্জ নিজে ফিতা কেটে ব্রিজটি উদ্বোধন করেন।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক-হানাদার বাহিনী এই ব্রিজের উপর দিয়ে ট্যাংক, যুদ্ধ সরঞ্জাম ও সৈন্য পারাপার করত। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে উত্তর-দক্ষিণবঙ্গের সাথে পাক-হানাদার বাহিনীর রেলওয়ে যোগাযোগ বন্ধ করতে ভারতীয় মিত্রবাহীনির একটি বিমান থেকে বোমা নিক্ষেপ করা হয়। বোমার আঘাতে ধ্বংস হয় হার্ডিঞ্জ ব্রিজের স্প্যানের একটি অংশ। দিনটি ছিল ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর। কুষ্টিয়া-ভেড়ামারা এবং পাবনার পাকশী এলাকায় তখন মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান ছিল। পাক হানাদার বাহিনী এই খবর জানার পর তাদের সমর শক্তি বৃদ্ধি করতে রেলওয়ে ব্রিজ ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিলে তৎকালীন ইপিআর এর ওয়ারলেস থেকে বিষয়টি অবহিত করা হয় বলে জানা যায়। এই খবর পাওয়ার পর মিত্র বাহিনীর একটি যুদ্ধ বিমান থেকে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের উপর বোমা নিক্ষেপ করা হলে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের ১২ নম্বর স্প্যান ভেঙ্গে পড়ে ও যোগাযোগ বিচ্ছন্ন হয়ে যায়। রণকৌশলে মুক্তিযোদ্ধারা আরও এগিয়ে যায়।
জানা যায়, বোমার আঘাতে ১২ নম্বর গাডার স্প্যানটি ভেঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় ছিল। কালের সাক্ষী হিসেবে ট্রেনের একটি ইঞ্জিন ও বোমের একটি অংশ পশ্চিম অঞ্চল রেলওয়ে হেডকোয়ার্টার পাকশীতে এখনো সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে।
শত বছর পার হয়ে গেলেও ব্রিজটিতে এখনও গতিসীমা ৫০ কি.মি. নির্দেশ করা হয়। বাংলাদেশ রেলওয়ে ব্রিজটির রক্ষণাবেক্ষণ ও নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছে।
২০১৫ সালের ৪ঠা মার্চ ব্রিজটির শতবর্ষ পূর্তি পালন করা হয়। বাংলাদেশ রেলওয়ে এবং বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন এই শতবর্ষ পূর্তি উৎসব পালন করে।
হার্ডিঞ্জ ব্রিজের পাশ দিয়ে সমান্তরালে ২০০৪ সালে একটি সড়ক সেতু নির্মাণ করা হয়। এ অঞ্চলের বিখ্যাত সাধক ফকির লালন শাহের নামানুসারে সেতুটির নাম রাখা হয় লালন শাহ সেতু। এই সড়ক সেতু নির্মাণের ফলে নতুন ও পুরাতনের মধ্যে এক মেলবন্ধন তৈরি হয়েছে ।
ব্রিজটি উপমহাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অন্যতম ধারক ও বাহক হওয়ায় দর্শনার্থী এখানে ভিড় জমায়। নির্মাণের পর থেকেই এই ব্রিজকে কেন্দ্র করে মানুষের কৌতূহলের শেষ ছিল না। সেসময় প্রমত্ত পদ্মার বুক চিরে নৌকা যোগে দূরদূরান্ত থেকে অসংখ্য কৌতূহলী মানুষ ব্রিজটি দেখতে আসত। মানুষের সেই কৌতূহল যেন আজও শেষ হয়নি।
শতবর্ষের ঐতিহ্য বহনকারী ব্রিটিশ শাসনামলে নির্মিত পাবনার হার্ডিঞ্জ রেলওয়ে ব্রিজ শুধু স্থাপনা নির্মাণ কৌশলের সাথেই নয়, এর ইতিহাসযুক্ত হয়েছে স্বাধীনতা যুদ্ধের সাথে।
দেশ স্বাধীনের পরে ভারত সরকারের সহযোগিতায় প্রথম হার্ডিঞ্জ ব্রিজের স্প্যান নির্মিত হয়। আর ঝুলে থাকা স্প্যাানটি ভেঙ্গে সরিয়ে নেবার চেষ্টা করা হয়। দুটি পন্টুন পদ্মা নদী বক্ষে রেখে ভাঙ্গা স্প্যান কেটে দেয়া হলে সেটি পন্টুনে পড়লে পন্টুন স্প্যানের লোহার ভার বহন করতে না পেরে দু'ভাগে সরে যায় আর বিশাল আকৃতির ১২ নম্বর স্প্যানটি তলিয়ে যায় পদ্মা নদী বক্ষে। ভারতের প্রকৌশলীরা স্প্যান তৈরী করলে সেটি আগের ডিজাইন মত না হওয়ায় পরে মূল নকশা অনুযায়ী ব্রিটিশ প্রকৌশলীরা পূর্বের আদলে স্প্যান তৈরী করে দেয়। ১৯৭৫ সালে নতুন করে সেটি প্রতিস্থাপন করা হয়। ওই বছরের ৫ আগস্ট হার্ডিঞ্জ ব্রিজ দিয়ে পুনরায় ট্রেন চলাচল শুরু হয়।
পদ্মা নদী বক্ষের পানি কমে যাওয়ায় দীর্ঘ ৪৪ বছর পরে জেগে উঠে পাকশীর পদ্মা নদীতে ডুবে যাওয়া সেই স্প্যানটি। তবে এটি সেখান থেকে আর সরানো যায়নি। হার্ডিঞ্জ ব্রিজ আর পরে নির্মিত লালন শাহ সড়ক সেতুর প্রায় এক কিলোমিটার দূরে ১২ নম্বর স্প্যানের অংশটি নদীর বুক থেকে ২০১৬ সালে জেগে উঠে মনে করিয়ে দিচ্ছে, স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসের সাথে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের ওতোপ্রতোভাবে জড়িয়ে থাকার কথা।