আর্কাইভ থেকে শিল্প-সাহিত্য

মায়ের প্রতি তাদের ভালোবাসা

মায়ের প্রতি তাদের ভালোবাসা

বিশ্ব মা দিবস আজ। মায়ের প্রতি আমাদের রয়েছে অগাধ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। আর এ ভালোবাসা প্রকাশের জন্যই তো প্রতি বছর মে মাসের দ্বিতীয় রোববার পালন করা হয় বিশ্ব মা দিবস।

মা আমাদের জীবনে সত্যিই আকাশের সমান ছায়া হয়ে থাকে। আমরা যতদিন মায়ের ছায়াতলে থাকি, ততদিন পৃথিবীটাকে বাধাহীন বিচরণভূমি বলে মনে হয়।মায়ের স্নেহের তুলনা হয় না পৃথিবীর আর কিছুর সঙ্গে।

তবে আজ মা দিবসে জানব জীবনানন্দ দাশ, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব বসু ও তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের মায়ের প্রতি ভালোবাসা কেমন ছিল, আবার তাদের প্রতি মায়ের ভালোবাসা কেমন ছিল।

জীবনানন্দ দাশ : বালক জীবনানন্দ দাশ অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকত কখন মা ঘরে আসবে। তারপরেই সে ঘুমাবে। আর ঘরের এক কোণে তার বাবা বাতি জ্বালিয়ে রাত অবধি লিখতেন। আর জীবনানন্দের মা তখনও রান্নাঘরে। যৌথ পরিবারের বড় হেঁশেল। পরিবারের প্রতিটি মানুষের খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত তিনি শুতে যাবেন না। তারপর সব কাজ শেষ করে ঘরে এলে এক দফা ছেলের সঙ্গে গল্প না করে ঘুমোতেন না। ছেলের সারাদিনের কাজের হিসেব নিতেন তখনই। তারপর ঘুমিয়ে পড়তে বলতেন।

এদিকে ঘুম না আসা পর্যন্ত জীবনানন্দের কেবলই ভয় করত এই বুঝি কোনও পড়শি তার মা-কে ডাকতে এল। কারণ পাড়াপড়শির রোগভোগে মা থাকতেন সব সময় পাশে। এমনকী কোনও দুঃস্থ পরিবারকে হয়তো ভিটেছাড়া করা হয়েছে, হয়তো কোনও ‘নিচু জাতের’ কেউ মারা গেছে, কার ঘরে কোনও পোয়াতি মায়ের প্রসব হবে, মার কাছে এক বার খবর এলেই হলো ঠিক চলে যেতেন। সারারাত হয়তো বাড়িই ফিরতেন না আর।

বালক জীবনানন্দর ডাকনাম ছিলো মিলু। সে তখনও জানতেই পারেনি তার মা কুসুমকুমারীর কবি হিসেবে কত সুখ্যাতি ছিলো। ‘ব্রহ্মবাদী’, ‘মুকুল’, ‘প্রবাসী’র মতো পত্রিকায় নিয়মিত তার লেখা বেরোত। তবে এত বড় পরিবারের ঝক্কি ঠেলে তত সময় দিতে পারেন না লেখার জন্যে।

তবুও জীবনানন্দ নিজেই দেখেছেন ‘সংসারের নানা কাজকর্মে খুবই ব্যস্ত আছেন তার মা, এমন সময়ে ‘ব্রহ্মবাদী’র সম্পাদক আচার্য মনোমোহন চক্রবর্তী এসে বললেন, এক্ষুনি ‘ব্রহ্মবাদী’র জন্য তোমার কবিতা চাই প্রেসে পাঠাতে হবে, লোক দাঁড়িয়ে আছে। শুনে মা খাতা-কলম নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে এক হাতে খুন্তি, আর এক হাতে কলম নাড়ছেন দেখা যেত এবং আশ্চর্য’র বিষয় এ যে চক্রবর্তীকে প্রায় তখনই কবিতা দিয়ে দিতেন তার মা’।আবার ছেলের জন্মদিনে তার বন্ধুদের, স্বামীর অফিসের লোকজনকে বাড়িতে নেমন্তন্ন করতেন কুসুমকুমারী। সেখানে গান হত। কবিতা পাঠও।

কখনও কখনও ছেলের বন্ধুদের নিয়ে বসাতেন সাহিত্যসভা সেখানে ছোটদের সঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্রর উপন্যাস, কি রামায়ণের নানান সব চরিত্র নিয়ে তর্কও করতেন। মুগ্ধ হয়ে তার কথা শুনত ছেলেমেয়েরা।

জীবনানন্দের মা কুসুমকুমারীই লিখেছিলেন ‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে?কথায় না বড় হয়ে, কাজে বড় হবে।’

তাই জীবনানন্দ যখন তারুণ্যের স্থূলতায় বড় বড় আদর্শ মহাপুরুষদের সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করতে শুরু করলেন, তখন মা তাকে বলেছিলেন ‘ও-রকম করে হয় না আগে তাদের মহত্ত্বে বিশ্বাস করো মনের নেতিধর্ম নষ্ট করে ফেলো; শুধু মহামানুষ কেন যে কোনও মানুষ কতখানি শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসের পাত্র অনুভব করতে শেখো’।

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় : বই পড়ার অভ্যাস মায়ের থেকে পেয়েছিলেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। তার মা প্রভাবতী দেবীর নিজেরই ছিল বই পড়ার দারুণ নেশা। আফিম খেতেন, তার ঝোঁকে সন্ধ্যার দিকে ঘুমিয়ে পড়তেন। দু’ঘণ্টা পর উঠে সবাইকে খাইয়ে একটা হ্যারিকেন জ্বালিয়ে পড়তে বসে যেতেন। রাত্রি দুটো পর্যন্ত আলো জ্বেলে বই পড়তেন তার মা।হাতের লেখা ছিল যেন মুক্তো। বানান নির্ভুল, ব্যাকরণেও ভুল করতেন না। এ নিয়ে একবার অদ্ভুত কান্ড ঘটে।তারাশঙ্করের বাবা মারা যাওয়ার পর বিষয়-সম্পত্তি সংক্রান্ত মামলায় দাখিল করা কাগজে মায়ের সই বা লেখা দেখে বিচারকের সন্দেহ হয়, এ কোনও মেয়ের লেখা হতেই পারে না! শুধু পড়াশুনো নয়, পুত্র বিস্মিত হতেন মায়ের সাহস আর স্থৈর্য দেখেও।

এদিকে গ্রামের বাড়ি। প্রায়ই ভূত বা প্রেতাত্মার গুজব ছড়াত। প্রভাবতীদেবীর তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই। সটান বেরিয়ে পড়তেন বাড়ি থেকে।নিজ চোখে দেখেশুনে অন্যের ভয় ভাঙাতেন।ঘরে সাপ ঢুকলে নিমেষে বুঝে ফেলতেন। সাপের গন্ধ নাকি টের পেতেন তিনি। একবার পায়ের উপর দিয়ে হেঁটে গেছে গোখরো সাপ। তাতে অচলা মূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে বিপদ এড়িয়েছিলেন তিনি।

মায়ের কথা তারাশঙ্কর লিখেছেন “আমার মায়ের দেহবর্ণ ছিল উজ্জ্বল শুভ্র। আর তাতে ছিল একটি দীপ্তি। চোখ দুটি স্বচ্ছ, তারা দুটি নীলাভ। কথাবার্তা অত্যন্ত মিষ্ট, প্রকৃতি অনমণীয় দৃঢ়, অথচ শান্ত। আমার মা যদি উপযুক্ত বেদীতে দাঁড়াবার সুযোগ পেতেন তবে তিনি দেশের বরণীয়াদের অন্যতমা হতেন এ বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ’।

শরচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় : জীবনযুদ্ধে কখনই হার মানতেন না শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মা ভুবনমোহিনী দেবী। ভুবনমোহিনীর বাবা কেদারনাথ ভাগলপুরের ধনী সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি ছিলেন। এই বাড়িতেই আশ্রিত ছিলেন মতিলাল চট্টোপাধ্যায়। মেয়েকে কাছে রাখবেন ভেবে মতিলালের সঙ্গে তার বিয়ে দিয়ে দিলেন কেদারনাথ। ঘরজামাই মতিলাল ছিলেন আয়েসি ও খুব শৌখিন। অর্থ উপার্জনের কোনো চেষ্টাই করতেন না। তিনি মজে থাকতেন তাস-দাবায়, তামাকের নেশায় আর দিবানিদ্রায়। স্কুল মাস্টারির চাকরি পেলেন বছর না ঘুরতেই তাতে ইস্তফা দিয়ে চলে এলেন। বাপের বাড়িতে লজ্জায় কুণ্ঠিত হয়ে থাকতে হয় ভুবনমোহিনীকে। তবু তিনি সংসারটাকে ভেসে যেতে দেননি।

মা সম্পর্কে শরৎচন্দ্র লিখেছেন ‘আমার মা ছিলেন খুবই উদারপ্রাণ। সংসারের সকল দুঃখ কষ্ট তিনি হাসিমুখেই সহ্য করতেন। ত্যাগ, কর্তব্যবোধ, নিষ্ঠা, স্নেহপ্রবণতা এসব গুণের সমন্বয়ে গঠিত ছিল তার চরিত্র’।

সংসারে ভুবনমোহিনীর ভূমিকা কী ছিল তা বোঝা যায় ১৯১৯ এর ২৪ আগস্ট শরৎচন্দ্রেরই লেখা একটি চিঠিতে “মায়ের মৃত্যুর পরে বাবা প্রায় পাগলের মতো হয়ে যা কিছু ছিল সমস্ত বিলিয়ে নষ্ট করে দিয়ে স্বর্গগত হন।

বুদ্ধদেব বসু : বুদ্ধদেব বসু তার দিদিমাকে ডাকতেন ‘মা’। বুদ্ধদেব বসুর মা বিনয়কুমারী বুদ্ধদেবের জন্মের পর চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে ধনুষ্টংকার রোগে মারা যান। আর এ মৃত্যুর জন্যই পুত্রের নাম রাখা হয় বুদ্ধদেব। বুদ্ধদেবের দিদিমার ব্যক্তিগত সম্পত্তির মধ্যে একটি ফটোগ্রাফ ছিল ক্ষীণাঙ্গ এক যুবক, তার কাঁধে মাথা রেখেছে এক তরুণী। আর তরুণীটির মুখটি গোল মতো, পিঠ-ছাপানো একরাশ চুল, কিন্তু চোখ তার বোজা, যুবকটি তার কোমর জড়িয়ে ধরে আছে। বুদ্ধদেব বসুর বাবা ভূদেবচন্দ্র বসু তার মৃত পত্নীকে নিয়ে ছবিটি তুলেছিলেন। এর পরেই তিনি সংসারত্যাগী হন। তারপর একমাত্র ওই ছবিটি নিয়ে কোনও কৌতূহল বা চিন্তা করার অবকাশ পাননি বুদ্ধদেব। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে, ষাট পেরোনো মানুষটির প্রান্তিক নির্জনতায় বসে ওই ছবির কথা মনে পড়ত তার।

সেই সঙ্গে বুদ্ধদেবর মনে হত ‘কেমন ছিল সে দেখতে, কেমন পছন্দ-অপছন্দ ছিল তার? বই পড়তে ভালোবাসত? আমার মধ্যে তার কোনও একটি অংশ কি কাজ করে যাচ্ছে? মনে হয় আমাকে জন্ম দেবার পরিশ্রমে যে মেয়েটির মৃত্যু হয়েছিল তার কিছু প্রাপ্য ছিল আমার কাছে’।

 

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন মায়ের | প্রতি | তাদের | ভালোবাসা