আর্কাইভ থেকে বাংলাদেশ

চালককে খুন করে ৫০০ টুকরো করলেন চিকিৎসক!

চালককে খুন করে ৫০০ টুকরো করলেন চিকিৎসক!

সমাজে চিকিৎসকদের প্রতি শ্রদ্ধার জায়গাটি বরাবরই অনেক উপরে। কিন্তু সেই চিকিৎসকই যদি প্রাণ কেড়ে নেন, তা হলে মানুষ কি আর তাদের আগের মতো ভরসা করতে পারবে! শুনতে অবাক লাগলেও এটাই সত্যি। ভারতের  ভোপালের বুকে এমনই এক নৃশংস ঘটনা ঘটেছে যা কিনা মধ্যপ্রদেশবাসীর রাতের ঘুম কেড়ে নেয়।

সময়টা ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি। মধ্যপ্রদেশের ডক্টর শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি সরকারি হাসপাতালের অভিজ্ঞ চিকিৎসক ছিলেন সুনীল মন্ত্রী। অস্থিসংক্রান্ত যে কোনও সমস্যার ক্ষেত্রে সকলে সুনীলের উপরেই আস্থা রাখতেন। হাসপাতালে সবচেয়ে সিনিয়র অর্থোপেডিক সার্জন হিসাবে প্রচুর নামডাক ছিল তার।

দুই ছেলেমেয়ে কর্মসূত্রে মুম্বইয়ে থাকায়, স্ত্রী সুষমা তার সঙ্গেই ভোপালে থাকতে শুরু করেন। আনন্দনগর এলাকায় দোতলা বাড়িতে থাকতেন সুনীল দম্পতি। সময় কাটানোর জন্যে বাড়ির নীচেই একটি বুটিকের দোকান খোলেন সুষমা। একা হাতে সব সামলাতে পারবেন না বলে দোকানে রানি বলে এক মহিলাকে নিয়োগ করেন তিনি। ২০১৭ সালে শারীরিক অসুস্থতার কারণে মৃত্যু হয় সুষমার। স্ত্রীর শেষ স্মৃতি হিসাবে সুষমার নিজের হাতে তৈরি করা বুটিকের দোকানটি বন্ধ না করার নির্দেশ দেন সুনীল।

কর্মচারী রানিকেই দোকান সামলানোর সম্পূর্ণ দায়িত্ব দেন সুনীল। এরপর হঠাৎ করেই রানির হাতে প্রচুর টাকাপয়সা আসতে থাকে। পরিবর্তন আসে তার পোশাকআশাক, হাবভাবে। হঠাৎ এমন আমূল পরিবর্তন লক্ষ করে সন্দেহ হয় রানির স্বামীর।

বীরেন্দ্র পচৌরী ওরফে বীরু ভাবেন তার স্ত্রীর কি তবে ডাক্তার সুনীলের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কে রয়েছে? না হলে হঠাৎ এত টাকা আসে কী করে? এ সন্দেহের বশেই তিনি রানির ফোনের কল রেকর্ড দেখেন। দেখতে পান, সুনীলের সঙ্গে প্রায়ই কথা হয়েছে রানির। এমনকি, টাকাপয়সার আদান-প্রদান নিয়েও কথা হয়েছে দু’জনের।

সব জানতে পেরে বীরু সোজা চলে যান সুনীলের বাড়িতে। পাড়াপড়শিকে সুনীলের ব্যাপারে সব খোলসা করে দেবেন বলে ভয় দেখাতে থাকেন বীরু। শুধু তাই’ই নয়, রানির সঙ্গে সম্পর্ক রাখলে হাসপাতালে গিয়েও সুনীলের আসল রূপ কী, তা জানিয়ে আসবেন এমন হুমকিও দেন।

সুনীল বার বার বোঝালেও বীরু কিছুতেই তার কথা মানতে নারাজ। দুর্নাম ছড়িয়ে পড়ে কিনা এ আশঙ্কায় শেষ পর্যন্ত সুনীল বীরুকে তার গাড়ি চালাতে অনুরোধ করেন। এ সুযোগে দিনের বেশির ভাগ সময় তার সঙ্গেই থাকতে পারবেন বীরু। 
যদি সুনীল ও রানির মধ্যে কোনও সম্পর্ক রয়ে থাকে, তবে তা খুব সহজেই ধরা পড়বে বীরুর চোখে। একই সঙ্গে তার মাসিক রোজগারও হবে। এমন চিন্তা করে অবশেষে ১৬ হাজার টাকা মাসিক বেতনে সুনীলের গাড়ি চালাতে রাজি হন তিনি।

চাকরি পাওয়ার পরেও তিনি সুনীলকে হুমকি দিতেন মাঝে মাঝেই। বার বার এ হুমকির কারণে সুনীল অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন। বীরু তার পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়াতে পারেন, এই ভেবে তাকে খুন করার সিদ্ধান্ত নেন সুনীল।

হাসপাতালে মৃতদেহের ময়নাতদন্ত বিভাগের সঙ্গে যুক্ত থাকায় সুনীল খুব ভাল করে জানতেন, কী করে খুন করার পর প্রমাণ গায়েব করতে হয়। পরিকল্পনা মাফিক প্রয়োজনীয় জিনিস জোগাড় করতে শুরু করেন তিনি।

অবশেষে সেই সুযোগও পেয়ে গেলেন। হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার সময় বীরু জানান, তার দাঁতে অসহ্য যন্ত্রণা করছে। সুনীল তাকে বাড়ির ভিতর আসতে বলেন এবং ব্যথা কমানোর জন্য ইনজেকশন দেন। আসলে ব্যথা কমানোর ওষুধের বদলে বীরুকে তিনি অজ্ঞান করার ওষুধ দিয়েছিলেন। বীরু সম্পূর্ণ অচেতন হলে সুনীল তাকে দোতলার বাথরুমে নিয়ে যান। সঙ্গে সঙ্গে তার গলার নলি লক্ষ করে ছুরি চালিয়ে খুন করেন বীরুকে।

৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, রাত ৯টা নাগাদ খুন করা হয় বীরুকে। এর পরেই শুরু হয় ভয়ঙ্কর ঘটনা। বীরুর মৃতদেহকে বাথরুমের মেঝেতে ফেলে টুকরো টুকরো করে কাটতে শুরু করেন সুনীল। দেহের টুকরোগুলি দেখে যাতে শনাক্ত করা না যায়, তাই তিনি ড্রাম-ভর্তি অ্যাসিডের মধ্যে ডুবিয়ে রাখেন টুকরোগুলি।

অ্যাসিড, ড্রাম এবং বড় আকারের বাসন সুনীল আগে থেকেই কিনে রেখেছিলেন। সোমবার সারা রাত ধরে বীরুর দেহ কাটতে থাকেন তিনি। পরদিন মঙ্গলবার সকালে বীরুর পরনের জামা-সহ রক্তে মাখা সমস্ত কাপড়ই তিনি বাড়ি থেকে কিছু দূরে ফেলে আসেন।

কেউ যাতে তাকে সন্দেহ না করে, তাই মঙ্গলবার সকালেও তিনি হাসপাতালে যান। দুপুর অবধি থেকে তিনি আবার বাড়ি ফিরে আসেন। আবার শুরু হয় মৃতদেহ কাটা। কিন্তু এর মধ্যেই প্রতিবেশীরা পুলিশের কাছে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেন। 

তারা অভিযোগ করে বলেন, চিকিৎসককে রক্তমাখা জামা গায়ে বাড়ির মধ্যে হাঁটাচলা করতে দেখা গিয়েছে। এমনকি, তার বাড়ির দিক থেকে আসা অদ্ভুত পোড়া গন্ধে তাদের সন্দেহ আরও বেড়েছে।

পুলিশ খোঁজ পেয়েই তার বাড়িতে তল্লাশি করতে আসে। বাড়ির ভিতর এসে তারা হাতেনাতে প্রমাণও পেয়ে যায়। ঘর জুড়ে রক্ত, মাংসের টুকরো ছড়ানো। বড় ড্রাম ও বাসনের ভিতরেও মাংসের টুকরো ভেসে রয়েছে।

পুলিশ আধিকারিক অরবিন্দ সাক্সেনা সেই মুহূর্তে ঘরের ভিতর উপস্থিত ছিলেন। তিনি পরে জানান, পুলিশরা যখন ঘরে ঢুকে, তখনও সুনীল মৃতদেহের কোমরের নীচের অংশ টুকরো টুকরো করে কাটছিলেন। আচমকা পুলিশদের দেখে তিনি হতভম্ব হয়ে পড়েন।

অ্যাসিডে দেহের টুকরোগুলি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় ঠিকমতো শনাক্ত করা যাচ্ছিল না, কাকে এভাবে খুন করেছেন সুনীল। পরে জিজ্ঞাসাবাদ চলাকালীন তিনি নিজেই সব স্বীকার করেন।

কিন্তু শুধুমাত্র সন্দেহ করতেন বলে একজনকে এত নৃশংস ভাবে খুন করা যেতে পারে, তা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না পুলিশ। তার বাড়ি থেকে প্রায় ৫০০ টি টুকরো উদ্ধার করা হয়। কিন্তু কেন এমন নৃশংস ভাবে হত্যা? 
তদন্তকারীদের অনুমান, হয়তো রানির সঙ্গে তার সত্যিই সম্পর্ক ছিল, ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়েই সুনীল খুন করেছেন, অথবা মানসিকভাবে অসুস্থ ছিলেন সুনীল। 

খুনের কারণ যাই হোক না কেন গোটা মধ্যপ্রদেশকে নাড়িয়ে দেয়এ ভয়ানক হত্যাকাণ্ড। চিকিৎসক হয়ে তিনি কী করে এক জন নির্দোষ ব্যক্তিকে এ ভাবে খুন করতে পারেন, তার উত্তর মেলেনি আজও। 

অনন্যা চৈতী

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন চালককে | খুন | করে | ৫০০ | টুকরো | চিকিৎসক