ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যভুক্ত দেশগুলোতে যেসব আশ্রয়প্রার্থীর আবেদন বাতিল হয়ে গেছে, তাদের নিজ দেশে ফেরানোর সংখ্যা বাড়াতে চায় ইইউ। এই জন্য বিদ্যমান আইনের ‘পূর্ণ ব্যবহার’ করা হবে। বললেন সুইডেনের অভিবাসন বিষয়ক মন্ত্রী মারিয়া মলমের স্ট্যানেরগার্ড।
গেলো সপ্তাহে তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যাচ্ছে না। এ বিষয়ে কাউন্সিলের কাছে ভিসা কড়াকড়ির প্রস্তাব দিতে ইউরোপীয় কমিশনকে আহ্বান জানিয়েছে সদস্য রাষ্ট্রগুলো। এই বিষয়ে গত বৃহস্পতিবার (২৬ জানুয়ারি) স্টকহোমে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে সদস্যরা একমত হয়েছেন বলেও জানিয়েছেন সুইডিশ মন্ত্রী।
বর্তমানে সভাপতি হিসেবে ইইউ বৈঠকের নেতৃত্ব দিচ্ছে সুইডেন। দেশটির কট্টর ডানপন্থি সরকার অবৈধ অভিবাসীদের নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে ভিসা, পররাষ্ট্রনীতি ও উন্নয়ন সহযোগিতাকে শর্ত হিসেবে ব্যবহারের বিষয়ে ইইউ’কে আগে থেকেই চাপ দিয়ে আসছে।
অবৈধ অভিবাসীদের প্রত্যাবাসনের বিষয়ে ইইউর কঠোর অবস্থান জানা গেছে ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডার লিয়েনের বক্তব্যেও। আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে স্টকহোমে জোটের সম্মেলন শুরুর আগে ইইউ দেশগুলোর নেতাদের কাছে পাঠানো চিঠিতে বিষয়টি আলোচ্যসূচিতে রাখার কথা উল্লেখ করেছেন তিনি।
লিয়েন জানান, বছরের প্রধমার্ধে ইইউ সদস্যরা একটি পাইলট প্রকল্পে সই করতে পারে। এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য হলো, আশ্রয় আবেদন ও যোগ্য প্রার্থীদের আশ্রয় প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা এবং যারা যোগ্যতা অর্জন করবে না, তাদের অবিলম্বে ফেরত পাঠানো।
অভিবাসীরা যেসব দেশ থেকে ইউরোপে যায়, সেগুলোর মধ্য থেকে ‘নিরাপদ দেশের' একটি তালিকা তৈরির প্রস্তাব দিয়েছেন ইসি প্রেসিডেন্ট। অর্থাৎ, যেসব দেশ নিরাপদ বিবেচিত হবে, সেসব দেশের আশ্রয়প্রার্থীদের আবেদন গৃহীত হওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে।
কিছু দেশের সঙ্গে নতুন করে প্রত্যাবর্তন চুক্তির পরিকল্পনার কথাও জানিয়েছেন ফন ডার লিয়েন। বার্তা সংস্থা এএফপি তার বরাত দিয়ে জানিয়েছে, ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া উন্নততর করতে ও বহির্গমন প্রতিরোধ করতে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, মিশর, মরক্কো, তিউনিশিয়া ও নাইজেরিয়ার সঙ্গে অভিবাসন চুক্তি সইয়ের পরিকল্পনা করেছে ইইউ।
ইইউ’র স্বরাষ্ট্র কমিশনার ইলভা জোহানসন বলেছেন, গেলো বছর প্রায় ১০ লাখ আশ্রয় আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ব্যাপক চাপে রয়েছে। এর বাইরে ইউক্রেন থেকে ৪০ লাখ শরণার্থীর আসায় দেশগুলোর আশ্রয়ের সক্ষমতা আরও কমে গেছে।
নিয়ম অনুযায়ী, ইউরোপীয় ইউনিয়নে প্রবেশের পর অবৈধ অভিবাসীরা জোটভুক্ত দেশগুলোতে আশ্রয় আবেদনের সুযোগ পান। প্রথমবার আবেদন বাতিল হলে তার বিরুদ্ধে আপিলেরও সুযোগ রয়েছে। এরপরও সেটি বাতিল হলে ফেরত যাওয়া বাধ্যতামূলক। এক্ষেত্রে স্বেচ্ছায় ফেরত যাওয়াদের জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের নানা সহায়তা প্রকল্প রয়েছে। এর সুযোগ নিয়ে কেউ না ফিরলে তাকে জোরপূর্বক ফেরত পাঠাতে পারে ইইউ দেশগুলো।
তবে ইউরোপীয় কমিশনের পরিসংখ্যান বলছে, ফেরত যাওয়ার নির্দেশের তুলনায় কার্যকর প্রত্যাবর্তনের হার অনেক কম। ২০২১ সালে ৩ লাখ ৪০ হাজার ৫০০ জনকে ফেরত যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হলেও সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়েছে মাত্র ২১ শতাংশের জন্য।
গেলো কয়েক বছরে ইইউ দেশগুলোতে অবৈধপথে বাংলাদেশিদের প্রবেশ বেড়েছে। বর্তমানে কেন্দ্রীয় ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপ যাওয়া লোকদের মধ্যে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছেন বাংলাদেশিরা। এছাড়া বলকান রুট হয়েও ইইউ সদস্য দেশগুলোতে পৌঁছানোর চেষ্টা করেন অনেকে। তাদের মধ্যে আশ্রয় আবেদন বাতিল হওয়া কয়েকশ নাগরিককে গত কয়েক বছরে দেশে ফেরত পাঠিয়েছে জার্মানি, গ্রিসসহ বিভিন্ন দেশ।
অভিবাসীদের ফেরত নিতে ঢাকার ওপর ব্রাসেলসের চাপ বাড়ছে। বৈধ কাগজবিহীন অভিবাসীদের ফেরাতে যথাযথ ব্যবস্থা না নেয়ায় ২০২১ সালের ১৫ জুলাই বাংলাদেশিদের ভিসা প্রক্রিয়ায় সাময়িক কড়াকড়ি আরোপের প্রস্তাব করেছিল ইউরোপীয় কমিশন। এই প্রস্তাবে সেসময় বাংলাদেশের সঙ্গে ইরাক এবং গাম্বিয়াকেও যুক্ত করা হয়েছিল।
বার্তা সংস্থা এএফপি অবশ্য জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত কেবল গাম্বিয়ার ওপরই ভিসা কড়াকড়ি আরোপ করেছে ইইউ। এতে দেশটির নাগরিকদের জন্য শেনজেন ভিসা পাওয়া কঠিন ও ব্যয়বহুল হয়ে গেছে। বাংলাদেশ ও ইরাকের বিরুদ্ধে একই ব্যবস্থা নেয়ার প্রস্তাব হলেও তা কার্যকর হয়নি।
গেলো নভেম্বরে বাংলাদেশ সফরকালে ইলভা জোহানসন বলেছিলেন, ভিসা নিষেধাজ্ঞার হুমকির পর ঢাকা অবৈধ অভিবাসীদের গ্রহণে ‘আরও উদার’ হয়েছে।
প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে বৈধ কাগজপত্র না থাকা অভিবাসীদের ফেরত নেয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশের সঙ্গে ইইউ’র স্ট্যান্ডার্ড অব প্রসিডিউর (এসওপি) চুক্তি হয়। সেটি বাস্তবায়নে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশকে চাপ দিয়ে এসেছে ইইউ।