আর্কাইভ থেকে দেশজুড়ে

সেনবাগের জামাল ‘অনিয়ম আর দুর্নীতির অভিযোগে’ ৩ বার চাকরি হারান

নোয়াখালীর সেনবাগের জামাল উদ্দিন। ‘অনিয়ম আর দুর্নীতির অভিযোগে তিনবার চাকুরিচ্যুত হয়েছেন’। একটি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট ফার্ম থেকে আত্মসাত করেছেন গ্রাহকদের প্রায় নয় কোটি টাকা। এসব অভিযোগে তার সাত বছর জেল হওয়ার কথা।  অথচ ২০১৯ সালে সেই ব্যাক্তিই বনে গেছেন রাষ্ট্রায়ত্ব প্রতিষ্ঠান জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান।  একসময় সর্বোচ্চ মুনাফাকারী ব্যাংকটি তার আমল থেকেই প্রতিদিন প্রায় আট হাজার কোটি টাকা ধার করে চলছে। ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ১৪ হাজার ৩৮৭ কোটি টাকা। ব্যাংকের এই বেহাল দশার দায়ী কে? সেই প্রশ্নে জবাবে আঙ্গুল যায় জামাল উদ্দিনের বিরুদ্ধেই।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ড. জামাল উদ্দিন- ২০১৯ সালের আগস্ট মাসে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান পদে তিন বছরের জন্য নিয়োগ পান। অথচ লোকটির অতীত পেশা জীবনের ইতিহাস ভালো ছিল না। যার কিছুটা অনুমান করা যায় একটি কল রেকর্ড থেকে। যেখানে একজন গ্রাহক বলেছেন- টাকা দিয়েছি হুদা ভাসির অ্যাকাউন্টে, পড়ে জেনেছি সেখানে জামাল উদ্দিন আমাদের প্রতারিত করেছে, ওটা হুদা ভাসির অ্যাকাউন্ট না।  এই ফোন কলের সূত্র ধরে বসুন্ধরার এক্সিম ব্যাংকে গিয়ে জানা যায়, ২০১১ সালের ৭ ডিসেম্বর হুদা ভাসি চৌধুরি অ্যান্ড কোম্পানির নামে একটি অ্যাকাউন্ট খোলেন জামাল উদ্দিন। সেই একাউন্টে টাকা দিয়ে প্রতারিত হয়েছিলেন এই গ্রাহক। পরে বাংলাদেশ ব্যাংক ও হুদাভাসি লিখিত অভিযোগ করলে অ্যাকাউন্টটি বন্ধ করে দেয়া হয়।

এক্সিম ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড ম্যানেজার মোঃ মাকসুদুল হক চৌধুরী জানান, ড. জামাল উদ্দিন অন্য একজনকে সাথে নিয়ে এসে অ্যাকাউন্ট খোলেন। ফল্ট করেছেন জামাল উদ্দিন সাহেব।জামাল উদ্দিন একজনকে এনে বললেন-ওনি নজরুল সাহেব আর আমি হুদা, অ্যাকাউন্ট খোলেন।

জামাল উদ্দিনের খোলা ঐ অ্যাকাউন্টের হিসাবে দেখা যায়, দুই বছরে কোম্পানির অগোচরে প্রায় চার কোটি ৬০ লাখ টাকা লেনদেন হয়েছে।

হুদা ভাসির প্রধান কার্যালয়ে গেলে, ক্যামেরার সামনে কথা বলতে চাননি প্রতিষ্ঠানটির নীতি নির্ধারকরা। তবে গোপন ক্যামেরায় ঘটনার সত্যতা পাওয়া যায়।

হুদা ভাসি চৌধুরি অ্যান্ড কোম্পানির সিনিয়র পার্টনার এ এফ নেসারুদ্দিন বলেন, ঘটনাটি প্রকাশ হয় ২০১৪ সালে। এটি গোপনে না, আমার জানি না। আমরা জামাল উদ্দিনকে ফার্মের টাকা নিয়ে আসতে বলা হলে, তিনি আসেননি।পরে আমরা তাকে বিদায় করে দিয়েছি।

হুদা ভাসির কর্তা ব্যাক্তিরা জানান, শুধু এক্সিম ব্যাংক নয়, জামাল উদ্দিন তাদের অগোচরে ঢাকার মৌলভীবাজারের উত্তরা ব্যাংকেও ভুয়া একাউন্ট করে গ্রাহকদের প্রতারিত করে হাতিয়ে নিয়েছেন প্রায় ৪ কোটি টাকা। মৌলভীবাজার শাখার স্টেটমেন্টে যার প্রমাণ পাওয়া যায়।

এসব অপকর্মের প্রমাণীত হওয়ায়, হুদাভাসি থেকে জামাল উদ্দিনকে বের করে দেওয়া হয়। তবে কোম্পানির টাকা এখন পর্যন্ত ফেরৎ দেননি জামাল।

জামাল উদ্দিনের কীর্তি এখানেই শেষ না, ২০০০ সালে আইপিডিসি ফ্যাইনান্স লিমিটেড থেকেও চাকরি হারান। মাত্র দুই বছরের মাথায় চাকরি হারানোর কারন নিয়ে মুখ খুলতে রাজী হননি ওই প্রতিষ্ঠানের কর্তব্যাক্তিরা। তবে সে সময়ে জামাল উদ্দিনের সিনিয়র হিসেবে কর্মরত মশিউল আলম চাকলাদার নামে একজন জানান, ষড়যন্ত্র ও অপেশাদার আচরণের কারণে চাকরি হারিয়েছেন জামাল উদ্দিন।

এমন বিতর্কিত জামালকেই ২০১৯ সালে জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান মনোনিত করা হয়। সুযোগ পেয়ে সেখানেও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন জামাল। নিজে পরিচালকের পদে থাকা ইউনিক পাওয়ার হাউজ নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে ২ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ দেয়ার প্রস্তাবনা দেন। তবে সুবিধা করতে পারেননি। অপরাধ প্রমানিত হওয়ায়, জনতা ব্যাংকের ইতিহাসে মাত্র ১১ মাসের মাথায় তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়।

জামাল উদ্দিন ইমার্জিং রেটিং এজেন্সি নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়েছেন। ওই প্রতিষ্ঠানের কাজই হচ্ছে কোনো প্রতিষ্ঠানের ঋণ শোধ করার সক্ষমতা যাচাই এবং রেটিং করা। যা ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে বড় প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। অথচ এমন এক প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারকেই দেয়া হয়েছিলো ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব।

২০১৩ সালে জনতা ব্যাংকের মোট আয় ছিলো নয়শ’ ৫৫ কোটি টাকা।  অথচ জামাল উদ্দিনদের আমলে ব্যাংকটির আয় ছিলো মাত্র  ৩০ কোটি টাকারও নীচে।

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন