আর্কাইভ থেকে দেশজুড়ে

এক দশক থেকে কাটছে শিকলে বাঁধা জীবন

কুড়িগ্রামে এক দশক থেকে শিকলে বাঁধা জীবন কাটছে দুটি পরিবারের দুই সদস্যের। মানসিক ভারসাম্যহীন হলেও বাঁচিয়ে রাখতে বাধ্য হয়ে শিকলে বেঁধে দেখভাল করছেন পরিবার দুটি।

জেলার উলিপুর উপজেলার ধামশ্রেণি ইউনিয়নের পোদ্দার পাড়ার দিনমজুর আবুদ্দির পুত্র হাবিবুর রহমান(১৪) এবং একই তবকপুর ইউনিয়নের সাদুল্যা সরকার পাড়ার বাসিন্দা দেলাবর হোসেনের পুত্র আসাদুল ইসলাম মিয়া(৩৬)। অন্য দশজনের মত স্বাভাবিক জীবন যাপন করলেও এখন তাদের শিকলবন্দী জীবন কাটছে প্রায় এক দশক ধরে। মানসিক ভারসাম্যহীন এই দু’জনের জীবনের গল্পটা কিন্তু একেবারেই আলাদা।

সরেজমিনে দেখা যায়, গরম থেকে রেহাই পেতে বাঁশ বাগানের নিচে স্থানীয় নারী-পুরুষ, শিশুরা রাস্তা এবং মাটিতে বসে সময় কাটাচ্ছেন। এই ভিড়ের আড়ালেই অমানবিক দৃশ্য চোখে পড়ে যায়। একটি বাঁশের সাথে শিকলে বাঁধা চৌদ্দ বছরের হাবিবুর রহমান। একটি পায়ের সাথে শিকল লাগিয়ে বাঁশের সাথে তালা দেয়া হয়েছে। শিকল পেচানো পায়ে কালো কালো ফোসকা পড়ে গেছে। প্রতিদিন কিশোরের সৎ মা এবং বাবা বাঁশের সাথে বেধে রেখে কাজ করেন। ঝড়-বৃষ্টি সবকিছুই কাটে তার এখানে। মাতৃহারা এই কিশোরের জীবন কাটছে প্রায় এক দশক ধরে।

প্রিয়তমা স্ত্রী তালাক দেবার পর থেকে মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়েন আসাদুল ইসলাম। আস্তে আস্তে মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন তিনি। এরমধ্যে তার মা মারা যাওয়ায় পুরোপুরি মানসিক বিকারগ্রস্থ হয়ে পড়েন তিনি। দরিদ্র পরিবারটি সঠিক চিকিৎসা করাতে না পেরে পায়ে শিকল বেধে দেন। এভাবেই চলছে তারও জীবন।

দিনমজুর আবুদ্দি বলেন,হাবিবুর জন্ম পর কয়েক বছর বেশ ভালো ছিল। তার ঝিকনি বেরাম(মৃগি রোগ) আছে। ওর মায়েরও ক্যানসার ধরা পড়ে। কামলা দিয়ে যা আয় হয় তা সংসারের পিছনেই শেষ। টাকা-পয়সার অভাবে স্ত্রী-সন্তানের ঠিকভাবে চিকিৎসা করাতে পারিনি। ছেলেটা আস্তে আস্তে পাগল হয়ে পড়ে। শুরুতে শিকল পড়ানো হতো না। কিন্তু রাস্তা দিয়ে মানুষ, গাড়ি গেলে ঢিল মারে। মাঝে মধ্যে হাবিবুর বাড়ি ছেড়ে বিভিন্ন স্থানে চলে যেতো। মাইকিং করে খোঁজ করে নিয়ে আসতে হতো। পরে বাধ্য হয়ে শিকল পড়িয়ে রাখা হয়। এরমধ্যে প্রায় ৬/৭ বছর আগে ওর মা মারা যায়। এরপর একটা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। তারও একটি সন্তান হয় সেও প্রতিবন্ধি হয়। এখন আমি সকালে হাবিবুরকে খাওয়ানো কাজ করে বাঁশের সাথে বেধে রেখে যাই। আমি কাজ থেকে ফেরত না আসা পর্যন্ত ওর সৎ মা বাকি সময়টা দেখভাল করে থাকে।

প্রতিবেশী নায়েব আলী বলেন, হাবিবুরের বাবা দিনমজুর।ঠিকমত দুবেলা ভাত খেতে পারে না ছেলের চিকিৎসা করাবে কিভাবে। আমার বিশ্বাস হাবিবুরকে ভালো চিকিৎসা করাতে পারলে সে ভালো হয়ে উঠত।

বৃদ্ধ দেলাবর হোসেন বলেন, অভাবের সংসারে হাল ধরতে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করে ঢাকায় পাড়ি জমান। সেখানে গার্মেন্টসে কাজ করেন। পরে পরিবারের সম্মতিতে বিয়ের করেন আসাদুল। বিয়ের এক বছরের মাথায় মারপিট ও অত্যাচার করার অভিযোগ তুলে একতরফা তালাক দিয়ে যায় তার স্ত্রী। আর এই ঘটনাকে মন থেকে মেনে নিতে না পেরে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে সে। পরিবার থেকে আরও দুইবার বিয়ে দিলেও কোন স্ত্রীকে মেনে নিতে পারেনি আসাদুল। এরমধ্যে প্রায় ১০/১১ বছর আগে ওর মা মারা যায়। এরপরই পাগল হয়ে পড়ে। প্রায় সময় আমাকেসহ প্রতিবেশিদের গায়ে হাত তুলতো। তাই বাধ্য হয়ে পায়ে শিকল বেধে দেয়া হয়েছে। প্রায় ১০বছর থেকে লোহার শিকল বাধা অবস্থায় চলা ফেরা করছে আসাদুল। বাড়িতে পরিবারে অন্য কোন সদস্য না থাকায় চা দোকান করে সংসার চালানোসহ রান্নার কাজও করেন এই বৃদ্ধ দেলবর হোসেন। এভাবেই তাদের জীবন কাটছে।

প্রতিবেশী রুবেল মিয়া বলেন, আমি দেখেছি আসাদুল ইসলাম বউ পাগল ছিল। বউ তাকে ছেড়ে যাওয়ার কারনে সে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন। পরে আরও দুটো বিয়ে দিয়েও সে সংসার টিকে নাই। তার সঠিক চিকিৎসা করা গেলে হয়তো ভালো হয়ে যেত।

জেলা প্রশাসক সাইদুল আরিফ বলেন, বিষয়টি জানার পর পরিবার দুটির দায়িত্ব নেয়া এবং চিকিৎসাসহ সরকারি সহযোগিতা করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবার আশ্বাস দেন।

এএম/

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন