আর্কাইভ থেকে বাংলাদেশ

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ভার্চুয়াল জগতে আসক্তি বাড়ছে শিশুদের

সন্তানদের নিয়ে যেন বিপাকেই পড়ছেন মা-বাবারা। করোনায় স্কুল বন্ধ, ঘরবন্দী জীবনে এইসব শিশুরা বইপত্র আর পড়ালেখা থেকে অনেক দূরে সড়ে যাচ্ছে। তাদের মধ্যে বাড়ছে মোবাইল আসক্তি। মোবাইল, ট্যাবেই তাদের দিন শুরু আর দিনের শেষ। অবাস্তব এক ভার্চুয়াল জগৎ যেন তিলেতিলে শেষ করে দিচ্ছে এসব শিশুদের মেধা মনন।  সরেজমিনে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য মিলেছে।

রাজধানীর শেওড়াপাড়া বাসিন্দা সিফাত তার দুই সন্তান স্কুলে পড়ে।

অনেকটা অভিযোগের সুরেই জানালেন, করোনা ভাইরাসের কারণে স্কুল বন্ধ থাকায় সারাক্ষণই বাসায় থাকছে তার সন্তানেরা। আসক্ত হয়ে পড়ছে মোবাইল এবং ইন্টারনেটের প্রতি। মনোযোগ হারাচ্ছে পড়াশুনায়।  পড়াশুনার কথা বললে কোন গরজ নেই বরং সারাক্ষণই মোবাইলে কি দেখবে সেই চিন্তাই মাথায় ঢুকে গেছে। 

এদিকে কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনলাইনে ক্লাস পরিচালনা করলেও বেশিরভাগগুলোই রয়েছে বন্ধ। যার কারণে ঘরবন্দী রয়েছে শিশুরা।

রাজধানীর ভিকারুন্নেসা স্কুলের এক শিক্ষার্থী লাবিবা বিরক্ত হয়ে পড়েছে , দ্রুত স্কুলে ফিরতে সে উদগ্রীব।

বাবা-মায়েরা বলছেন, শিশুরা বাসায় থাকলেও তারা নিয়মতান্ত্রিক জীবনে অভ্যস্ত হচ্ছে না। বরং সারাক্ষণই তাদের মেজাজ খারাপ থাকে। শিশুর মধ্যে দেখা দিচ্ছে আচরণগত পরিবর্তনও। মোবাইলের গেমসের মত অবাস্তবতাকে, বাস্তব জীবনের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলছেন তাদের সন্তানেরা। 

মনোবিজ্ঞানী ডা. মেখলা সরকার জানালেন, দীর্ঘ সময় স্কুলের বাইরে থাকার কারণে অনেক শিশুর মধ্যেই আচরণগত পরিবর্তন আসতে পারে। এমন পরিস্থিতি একদিকে যেমন তাদের সঠিক মানসিক বিকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে অন্যদিকে নিয়মতান্ত্রিক জীবনে অনভ্যস্ত হওয়ার প্রবণতা তৈরি হতে পারে শিশুদের মধ্যে। 

চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানীরা আরো আশঙ্কা প্রকাশ করে বলছেন, অনলাইন ক্লাসের কারণে শিশুদের মোবাইল এবং ইন্টানেটের প্রতি আসক্তি বাড়তে পারে।

মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ন্যাশনাল ট্রমা কাউন্সিল সেন্টারের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ইসরাত শারমিন রহমান বলেন, অনেকের আচরণগত সমস্যা হচ্ছে, অনেকে প্রচণ্ড জেদ করছে, ইমোশনাল রিঅ্যাকশন হচ্ছে, কান্নাকাটি করছে কেউ কেউ, কেউ হয়তো জেদ করে কোন কাজ করা বন্ধ করে দিচ্ছে, ইন্টারনেট ও মোবাইল ব্যবহার বাড়ছে। 

তিনি জানান, বয়সে কিছুটা বড় বা কিশোরদের মধ্যে এই প্রতিক্রিয়া কিছুটা ভিন্ন হচ্ছে। বয়সে একটু বড়রা পরিবারের অন্যদের সাথে দূরত্ব তৈরি করছে, আইসোলেটেড হয়ে আছে, তারা তাদের রুমেই বেশি সময় কাটাচ্ছে, এই বিষয়গুলো হচ্ছে। আর এ ধরণের আচরণগত পরিবর্তন শিশুদেরকে মহামারি পরবর্তী জীবনেও তাদের খাপ-খাইয়ে নিতে অসুবিধার সৃষ্টি করবে।

তিনি বলেন, একা থাকতে থাকতে বাচ্চারা অভ্যস্ত হয়ে পড়বে। অনেকেই তখন স্কুলে যেতে চাইবে না, বন্ধুদের সাথে মেলামেশা এবং সামাজিকীকরণেও এক ধরণের সমস্যা তৈরি হতে পারে।

ইউনেস্কোর তথ্য অনুযায়ী, করোনায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের তালিকায় বিশ্বে সবার উপরে বাংলাদেশ। কিন্তু উল্টো অবস্থা আক্রান্তের হারে। শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগ টিকাও দেয়া হয়ে গেছে। তারপরও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কেন বন্ধ এমন প্রশ্ন অনেকের। 

সমাজবিজ্ঞানী ডক্টর জিনাত হাকিম বলছেন, করোনাভাইরাসের কারণে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে শিশুদের মানসিক এবং সামাজিক উন্নয়ন ও বিকাশে বাবা-মাকেই সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করতে হবে।
শিশুরা যাতে পরিবারে থেকেই নিয়মতান্ত্রিক জীবনে অভ্যস্ত থাকে সেটি নিশ্চিত করতে হবে। শিশুরা হতাশ হয়ে গেলে বাবা-মাকে তাদের পাশে থাকতে হবে।
তারা বলছেন স্কুল বন্ধ থাকলেও শিশুদের নিয়মতান্ত্রিক জীবনে অভ্যস্ত রাখতে হলে তাদের দৈনন্দিন কাজের একটি রুটিন করে দেয়া যেতে পারে।

সেক্ষেত্রে সকালে ঘুম থেকে ওঠা থেকে শুরু করে, ধর্মীয় প্রার্থনা, খাবার ও ঘুমানোর সময়, বাবা-মায়ের সাথে বিভিন্ন কাজে অংশ নেয়া এবং পড়াশুনার জন্যও একটা সময় বেঁধে দিতে হবে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, করোনার মধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে বাচ্চাদের। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক প্রফেসর ডক্টর সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক বলছেন, করোনা সঙ্গে যুদ্ধ করেই বেঁচে থাকতে হবে। যার কারণে বৃহত্তর পরিকল্পনার দিকে যাচ্ছে সরকার।

জাতির অপূরণীয় ক্ষতি হওয়ার আগেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে শিগগিরই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার পক্ষে মত, অভিভাবক, শিক্ষকসহ সবার। করোনার কারণে ৫৪৪ দিন পর স্কুল-কলেজ খুললেও ওমিক্রনের প্রভাবে আবারও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কবে নাগাদ আবার খুলবে সেটা যেন অনিশ্চিতই বটে। 

মুক্তা মাহমুদ 

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন