‘সবাই বাঁচুক, শুধু শুধু পৃথিবীর অক্সিজেন আর নষ্ট করতে চাই না’
ফিরোজের টেবিলে রাখা প্যাডে লেখা ছিলো, ‘মানুষ বাঁচে তার সম্মানে। আজ মানুষের সামনে আমার যেহেতু সম্মান নাই। এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার আমার কোনো অধিকার নাই। আমারে মৃত্যুর দায়ভার একান্ত আমার। সরি মা! বাড়ি থেকে তোমাকে দিয়ে আসা কথা রাখতে পারলাম না। আমার জীবন নিয়ে হতাশ।’ এই পৃষ্ঠার উপরে ১৯/০৯/২৩ তারিখ এবং নিচে ফিরোজের নাম ও রাত ১১:০৩ সময় উল্লেখ করা ছিলো। তবে এটি ফিরোজের হাতের লেখা কিনা তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
পৃষ্ঠার বাকি অর্ধেকে ‘রাত ১১টা ৫ মিনিট সময় উল্লেখ করে লেখা ছিল, ‘আমার ওয়ালেটের কার্ডে কিছু টাকা আছে। বন্ধুদের কাছে অনুরোধ রইলো মায়ের হাতে দিতে। আমার লাশের পোস্টমর্টেম না করে যেন বড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। কোনো আইনি ঝামেলায় কাউকে যেন জড়ানো না হয়। সবাই বাঁচুক, শুধু শুধু পৃথিবীর অক্সিজেন আর নষ্ট করতে চাই না।’ এই লেখার নিচে আবারও লেখা রয়েছে, ‘ফিরোজ।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) বিজয় ৭১ হল থেকে পড়ে ফিরোজ কাজী (২২) নামে এক শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনায় একটি চিরকুট ঘিরে নতুন রহস্য তৈরি হয়েছে। এ শিক্ষার্থীর মৃত্যু দুর্ঘটনা নাকি আত্মহত্যা তা নিয়ে ধোঁয়াশার মধ্যে মঙ্গলবার রাত পৌনে ২টায় তার টেবিলে রাখা প্যাডের কিছু লেখা নিয়ে চাঞ্চল্য তৈরি হয়।
এর আগে এদিন রাত ১টার দিকে হলের যমুনা ব্লকের সাত তলা থেকে পড়ে যান ফিরোজ। পরে তাৎক্ষণিক তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (ঢামেক) নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তিনি ঢাবির চাইনিজ ল্যাঙ্গুয়েজ এন্ড কালচার বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি জিয়াউর রহমান হলের ২০৩ নম্বর কক্ষে থাকতেন।
জানা গেছে, মঙ্গলবার রাত ২টা ৪০ মিনিটে ফিরোজের কক্ষে গিয়ে টেবিলে রাখা একটি প্যাডে কিছু লেখা দেখতে পান তার বন্ধুরা। এ সময় তার টেবিলে মুরগির মাংস ও ভাত রাখা ছিল। বন্ধুরা তার জন্য খাবার রুমে এনে রেখেছিলেন। ফিরোজ তা না খেয়েই হঠাৎ রুম থেকে বেরিয়ে যান। কিছুক্ষণ পরই বিজয় ৭১ হলের ভবন থেকে পড়ে যাওয়ার খবর পান তার বন্ধুরা। তবে তিনি বিজয় ৭১ হলে কার কাছে গিয়েছিলেন তা জানা নেই বলে জানিয়েছেন তার বন্ধুরা।
কাজী ফিরোজের কয়েকজন বন্ধু জানিয়েছেন, এই লেখাটা তাদের কাছে ফিরোজের হাতের লেখার মতোই মনে হয়েছে।
তবে ফিরোজের মৃত্যুর খবর শুনে হাসপাতালে আসা তার বড় ভাই জানিয়েছেন, তার ও ফিরোজের লেখা প্রায় একই। প্যাড খাতায় থাকা এই লেখাটা ফিরোজের হাতের লেখা নয়। এরপর তারা ফিরোজের মরদেহের পোস্টমর্টেম করার সিদ্ধান্ত নেন।
জানা গেছে, অন্যদিকে ফিরোজের কয়েকজন বন্ধু ঘটনার বেশ কিছুক্ষণ আগে থেকেই হলগেটে তাকে খুঁজছিলেন। একে ওকে জিজ্ঞেস করছিলেন তার কথা। অনেক্ষণ থেকেই তাকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছিল না। কয়েকদিন থেকে তাকে বিষন্ন দেখাচ্ছিল।
মঙ্গলবার (১৯ সেপ্টেম্বর) দিবাগত রাত ১টার দিকে তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে এলে কর্তব্যরত চিকিৎসক পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে মৃত ঘোষণা করেন।
ফিরোজ কাজীকে হাসপাতালে নিয়ে আসা ঢাবি শিক্ষার্থী মাহিম খান বলেন, ফিরোজ জিয়াউর রহমান হলে থাকতেন। আমরা বিজয় ৭১ হলে থাকি। আজ রাতে আমরা হঠাৎ একটি শব্দ শুনতে পাই। গিয়ে দেখি ফিরোজ কাজী নিচে পড়ে আছেন। পরে আমরা তাকে দ্রুত উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে এলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
তিনি বলেন, ফিরোজ বিজয় ৭১ হল থেকে লাফিয়ে পড়েছেন নাকি অসাবধানতাবশত পড়ে গেছেন, সে বিষয়টি বলতে পারছি না। তার শরীরে তেমন কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই। তিনি বিজয় ৭১ হলে কার কাছে এসেছিলেন, সে বিষয়টিও জানা নেই।
কাজী ফিরোজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯-২০ সেশনের চাইনিজ ল্যাঙ্গুয়েজ এন্ড কালচার বিভাগের শিক্ষার্থী। তার গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জ।
টিআর/