আর্কাইভ থেকে টুকিটাকি

রক্ত দিয়ে কেক আর চর্বি গলিয়ে তৈরি করেছিলেন সাবান!

তার গল্প শুনলে এখনও শিহরিত হয়ে ওঠেন ইতালির মানুষজন। ‘করেজিয়োর সাবান নির্মাতা’ বলেই পরিচিত লিওনার্দা সিয়ানসিউলি। তিন জন মহিলাকে খুন করে তাদের দেহাবশেষ দিয়ে তৈরি করেছিলেন সাবান আর কেক। আর এই সবটাই করেছিলেন নিজের সন্তানকে রক্ষা করতে। ১৮৯৪ সালের ১৮ এপ্রিল ইতালির মন্তেল্লা শহরে জন্ম হয় লিওনার্দার। ছোটবেলা কেটেছিল চরম দুঃখে। দু’বার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন।

একবিংশ শতকের গোড়ার দিকের কথা। বিয়ের পর ১৭ বার সন্তানধারণ করেছিলেন লিওনার্দা। তিনটি সন্তান গর্ভে থাকাকালীন মারা গিয়েছিল। ১০ জন সন্তান ছোটবেলাতেই মারা গিয়েছিল। বাকি চার জনকে বাঁচানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন লিওনার্দা।

বাড়ির অমতে ১৯১৭ সালে রেজিস্ট্রি অফিসের কেরানি রাফায়েল পানসার্ডিকে বিয়ে করেন লিওনার্দা। তার দাবি, সে কারণে মা তাকে অভিশাপ দেন। তার ধারণা, মায়ের অভিশাপের কারণে জীবনে সুখি হতে পারেননি তিনি।

ইতালি, লিনার্দার বিয়ে

১৯৩৯ সালে লিওনার্দার বড় ছেলে গিসেপ পানসার্ডি ঘোষণা করেন, তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইতালির হয়ে যুদ্ধ করতে যাবেন। শুনে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। আর সে কারণেই নেন চরম পদক্ষেপ। হয়ে ওঠেন সিরিয়াল কিলার।

এর আগে ১৯২৭ সালে প্রতারণার অভিযোগে গ্রেপ্তার হন লিওনার্দা। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে সপরিবারে পোটেনজা থেকে ল্যাসিডোনিয়া চলে যান তারা। সেখানেও নেমে আসে দুঃসময়। ১৯৩০ সালের জুলাইয়ে ভয়াবহ ভূমিকম্প হয় ইতালিতে। হাজার মানুষের সঙ্গে ঘর ভেঙে যায় লিওনার্দারও।

তত দিনে নিজের বেশ কয়েক জন সন্তানকে হারিয়েছেন লিওনার্দা। মায়ের অভিশাপ, গ্রেপ্তারি, সন্তানদের মৃত্যু, ঘর ভেঙে পড়া- এ সব কারণে মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছিলেন লিওনার্দা। এক জ্যোতিষীর কাছে গিয়েছিলেন। সেই জ্যোতিষীও তার হাতে দেখে বলেছিলেন, ভবিষ্যতে জেলে যেতে হবে তাকে। অপরাধে জড়িয়ে পড়বেন তিনি।

জ্যোতিষীর এ কথা শুনে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন লিওনার্দা। অবসাদে ভুগতে শুরু করেন। কিন্তু দক্ষিণ ইটালির ছোট্ট ওই শহরে সে সময় মানসিক চিকিৎসার ব্যবস্থা ছিল না। তাই লিওনার্দার অসুস্থতা ক্রমেই বাড়তে থাকে।

মনে করা হয়, সেই অবসাদ থেকেই কুসংস্কারাচ্ছন্ন হয়ে পড়েন লিওনার্দা। এর মধ্যেই ১৯৩৯ সালে ছেলে গিসেপ ঘোষণা করেন যুদ্ধে যাওয়ার কথা। লিওনার্দার মনে হয়, একমাত্র মানুষ বলি দিলেই ছেলের প্রাণ বাঁচবে।

 

কোথা থেকে এ ভাবনা জন্মেছিল লিওনার্দার, তা জানা যায় না। সে সময় ইতালিতে রোমান ক্যাথলিক ধর্ম প্রতিষ্ঠিত ছিল। সেই ধর্মে মানববলি নিষিদ্ধ ছিল।

লিওনার্দা সে সব তোয়াক্কা না করেই তিন মহিলাকে খুন করেন। স্থানীয় এক অবিবাহিত মহিলা ফস্টিনা সেট্টি ছিলেন লিওনার্দার প্রথম নিশানা। তার জন্য পাত্র খুঁজে দেবেন বলে বাড়িতে ডেকেছিলেন ক্রিস্টিনা।

লিওনার্দা

সময়টা ছিল ১৯৩৯ সাল। বাড়িতে ডেকে ক্রিস্টিনাকে দিয়ে তার পরিবারের উদ্দেশে একটি চিঠি লেখান লিওনার্দা। তার নির্দেশে সেই চিঠিতে ক্রিস্টিনা লিখেছিলেন, তিনি বিদেশে এক পাত্রের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন। এর পরেই মাদক মেশানো ওয়াইন খাওয়ান ক্রিস্টিনাকে।

অচেতন হয়ে পড়েন ক্রিস্টিনা। তার পরেই তাকে কুঠার দিয়ে খুন করেন লিওনার্দা। এরপর ক্রিস্টিনার দেহ ন’টুকরো করেন তিনি। আর রক্ত জমিয়ে রাখেন একটি বেসিনে।

পরে পুলিশকে জেরায় লিওনার্দা জানিয়েছিলেন, একটি বড় পাত্রে ক্রিস্টিনার দেহের টুকরোগুলি রেখে তাতে কস্টিক সোডা মিশিয়েছিলেন। সাবান তৈরির জন্য বাজার থেকে ওই সাত কেজি কস্টিক সোডা কিনে এনেছিলেন তিনি। কস্টিক সোডার রাসায়নিক ক্রিয়ায় ক্রিস্টিনার দেহাংশ থকথকে কালো মণ্ডে পরিণত হয়েছিল। সেই মণ্ড বালতিতে ভরে সেপটিক ট্যাঙ্কে ফেলে দিয়েছিলেন লিওনার্দা।

এখানেই ভয়াবহতার শেষ নয়। ক্রিস্টিনার রক্ত ওভেনের আঁচে শুকিয়েছিলেন লিওনার্দা। তারপর গুঁড়ো করেছিলেন। তারপর সেই গুঁড়োর সঙ্গে ডিম, ময়দা, চকোলেট, মার্জারিন, চিনি, দুধ মিশিয়ে কেক তৈরি করেছিলেন।

ইতালি, লিওনার্দা

পুলিশি জেরায় লিওনার্দা বলেছিলেন, ‘‘যারা আমার বাড়িতে আসতেন, তাদের ওই কেক খেতে দিতাম। আমিও খেয়েছি ওই কেক।’’ ক্রিস্টিনার জমানো টাকাও হাতিয়েছিলেন লিওনার্দা। ৩০ হাজার ইতালিয়ান লিরে। সে সময়ের হিসাবে বাংলাদেশি মুদ্রায় যা প্রায় ১৮০০ টাকা। যদিও সে সময় এর মূল্য ছিল অনেক বেশি।

১৯৪০ সালের ৫ সেপ্টেম্বর আরও এক মহিলাকে একই ভাবে খুন করেন লিওনার্দা। তার নাম ফ্রান্সেসকা সোয়াভি। লিওনার্দা তাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, বিদেশে শিক্ষকের চাকরি পাইয়ে দেবেন। এই বলে বাড়িতে ডেকে একই ভাবে খুন করেছিলেন।

সোয়াভিকে দিয়েও খুনের আগে চিঠি লিখিয়ে নেন লিওনার্দা। সেখানে তিনি লিখেছিলেন, চাকরি পেয়ে বিদেশ যাচ্ছেন তিনি। এরপর একই ভাবে তাকে খুন করে তার রক্ত দিয়েও তৈরি করেছিলেন কেক। চুরি করেছিলেন তার জমানো টাকা।

ওই ঘটনার ক’দিন পর, ৩০ সেপ্টেম্বর ভার্জিনিয়া কাসিয়োপ্পো নামে এক মহিলাকে নিশানা করেন লিওনার্দা। তিনি অপেরায় গান গাইতেন। লিওনার্দা প্রতিশ্রুতি দেন, ফ্লোরেন্সে বড় অপেরা দলে তার কাজ খুঁজে দেবেন। এভাবে তাকে ডেকেও একই ভাবে খুন করেছিলেন লিওনার্দা।

ভার্জিনিয়া শরীর ছিল স্থূল। তার দেহ থেকে চর্বি সংগ্রহ করে তার সঙ্গে মিশিয়েছিলেন সুগন্ধি। তারপর সেই চর্বি ফুটিয়ে ফুটিয়ে সাবান তৈরি করেছিলেন। সেই সাবান আবার বিলি করেছিলেন পাড়ায়। আত্মীয়দেরও দিয়েছিলেন বলে জেরায় জানিয়েছিলেন লিওনার্দা।

ইতালি, লিওনার্দা

পুলিশকে লিওনার্দা বলেছিলেন, ‘‘ওই মহিলা সত্যিই খুব মিষ্টি ছিলেন। তার রক্ত দিয়ে তৈরি কেকও দারুণ সুস্বাদু হয়েছিল। বাকিদের থেকে অনেক ভাল।’’

দীর্ঘ দিন ভার্জিনিয়ার খোঁজ না পেয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিলেন তার বৌদি। খোঁজখবর শুরু করেছিলেন। ননদকে শেষ বার লিওনার্দার বাড়িতে ঢুকতে দেখেছিলেন তিনি। সে কথাও জানিয়েছিলেন পুলিশকে। তারপরেই তদন্তে নামে পুলিশ।

প্রাথমিক তদন্তের পর পুলিশ জেরা শুরু করে লিওনার্দাকে। তিনি খুনের কথা অস্বীকার করেন। এরপর পুলিশ তার ছেলেকে আটক করে। তখনই ভেঙে পড়ে দোষ স্বীকার করেন তিনি। আদালতে বিচার হয়। ৩৩ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়।

ইতালি, লিওনার্দা

১৯৭০ সালের ১৫ অক্টোবর জেলেই মৃত্যু হয় লিওনার্দার। সেরিব্রাল হ্যামারেজ হয়েছিল। তখন ৭৯ বছর বয়স হয়েছিল তার। লিওনার্দার দেহ পরিবারের হাতে তুলে দেয়া হয়। রোমের ক্রিমিনোলজি জাদুঘরে আজও সাজানো রয়েছে তার খুনের অস্ত্র, সেই পাত্র।

 

সূত্র: অল দ্যাট ইন্টারেস্টিং

 

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন