আর্কাইভ থেকে জাতীয়

নৌকা পাননি আলোচিত-সমালোচিত যেসব আওয়ামী লীগ নেতা

আসছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংসদের ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৯৮টি আসনে দলীয় প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে। এই  ঘোষণাকে কেন্দ্র করে আওয়ামী দলীয় নেতাকর্মীদের মাঝে বেশ কয়েকদিন ধরেই আলোচনা চলছিলো দলের শীর্ষ হাইকমান্ড এবার মনোনয়নের ক্ষেত্রে চমক আনবেন। বলা হচ্ছিলো আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে অনেক বিষয় বিবেচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন। গুঞ্জন ছিলো লুটপাট, দখল, দুর্নীতি,দলীয় কোন্দল, নেতাকর্মীদের থেকে সরে যাওয়া,বিতর্কিত মন্তব্যসহ নানা কারণে যারা বিভিন্ন সময় সমালোচিত ও বিতর্কিত হয়েছেন তাদের অনেকেই হয়তো এবার নমিনেশন পাবেন না। রোববার(২৬ নভেম্বর) ঘোষণা করা আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রার্থীদের তালিকা বিশ্লেষণ করলে তারই চিত্র পাওয়া গেছে। তাদের বাদ দিয়েই আওয়ামী লীগ চূড়ান্ত করেছে ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় নির্বাচনের প্রার্থীতা তালিকা।

সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসান: একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামালপুর-৪ আসন  থেকে জয়ী এই সংসদ সদস্য তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী থাকাকালে  তার অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ ফোনালাপ ফাঁস হয়। এঘটনায় দলের ভেতরে ও বাইরে ব্যাপক সমালোচনার মুখে ওই সময় প্রতিমন্ত্রী থেকে পদত্যাগে বাধ্য হন তিনি। আওয়ামী লীগ তাকে নিয়ে বেশ বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে।  একারণেই এবার  নৌকার মনোনয়ন পাননি বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। তার জায়গায় নৌকার মাঝি হিসেবে এসেছেন মো. মাহবুবুর রহমান। আওয়ামী লীগের একসময়কার  সংসদ সদস্য আব্দুল মালেকের ছেলে মাহবুবুর রহমান  বর্তমানে স্বেচ্ছাসেবক লীগের মৎস্য ও প্রাণিবিষয়ক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

খন্দকার মোশাররফ হোসেন: একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী এই সংসদ সদস্য ফরিদপুর-৩ আসন থেকে এবার নৌকার  মনোনয়ন পাননি। আওয়ামী লীগ সরকারের পরপর দুই মেয়াদে মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। তবে বর্তমান সরকারের মন্ত্রিসভায় না থাকলেও বেশ আলোচনায় ছিলেন।  ফরিদপুর জেলা শাখা  ছাত্রলীগের দুই নেতা রুবেল-বরকতের হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ নিয়ে মোশাররফ হোসেন আলোচনায় আসেন। তাঁর আসনে এবার মনোনয়ন পেয়েছেন জেলা শাখা আওয়ামী লীগের সভাপতি শামীম হক।

জাকির হোসেন: কুড়িগ্রাম-৪ আসনে  এবার নৌকার মনোনয়ন পাননি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন। বিতর্কিত মন্তব্যের জন্য তিনি মনোনয়ন পাননি বলে ধারণা করছেন দলের অনেকেই। এই আসনে এবার মনোনয়ন পেয়েছেন আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণাবিষয়ক উপকমিটির সদস্য মো. বিপ্লব হাসান। তিনি ছাত্রলীগের সোহাগ–নাজমুল কমিটির উপ–আইনবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন।

২০২২ সালের ১৫ আগষ্ট কুড়িগ্রামে জাতীয় শোক দিবসের অনুষ্ঠানে দেওয়া প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনের একটি বক্তব্য ফেইসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। ওইদিন কুড়িগ্রামের রাজীবপুর উপজেলা শাখা আওয়ামী লীগ আয়োজিত জাতীয় শোক দিবসের অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তব্যের এক পর্যায়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, “আমরা মন থেকে তার জন্য দোয়া করব, বঙ্গবন্ধুকে আল্লাহ যেন জাহান্নামের ভালো জায়গায় স্থান করে দেয়।” পরে অবশ্য নিজের ভুল ঠিক করে বঙ্গবন্ধুকে জান্নাত দানের দোয়া করেন।তবে তার এই বক্তব্য সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়লে বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে আওয়ামী লীগ ও দলের নেতাকর্মীরা।

এছাড়া, নৌকার টিকিটে মনোনয়নপত্র চূড়ান্তের শেষ সময়ে তার বিরুদ্ধে একাট্টা হন স্থানীয় নেতাকর্মীরা। তাকে দলীয় মনোনয়ন না দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি লিখিত আবেদন করেন ওই আসনের আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী ১৬ নেতা।

মহিউদ্দিন খান আলমগীর: আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সাবেক সদস্য,সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বর্তমান সংসদ সদস্য মহিউদ্দীন খান আলমগীর এবার নৌকার প্রার্থী হতে পারেননি। কচুয়া উপজেলা নিয়ে  গঠিত চাঁদপুর-১ আসনে এবার নৌকার মাঝি হয়েছেন আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক সেলিম মাহমুদ।

ফারমার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যান থাকাকালে ব্যাংক কেলেঙ্কারি নিয়ে তাঁর নাম আলোচনায় আসে। তবে মহিউদ্দিন খান আলমগীর ওই অভিযোগগুলো অস্বীকার করেন। অভিযোগগুলো সম্পূর্ণ কল্পনাভিত্তিক ও অনুমাননির্ভর বলে জাতীয় সংসদে দাবি করেন সাবেক এই হেভিওয়েট আমলা।

পঙ্কজ নাথ: বরিশাল-৪ আসনে পরপর দুবার সংসদ সদস্য হয়েছিলেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক পঙ্কজ নাথ। তবে এবার বাদ পড়লেন মনোনয়ন থেকে। প্রথমবারের মতো প্রার্থী হিসেবে এই আসনে নৌকার প্রার্থী  মনোনীত হয়েছেন আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক শাম্মী আহমেদ।

হিজলা ও মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলা নিয়ে গঠিত এই আসনে পরপর দুইবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেও নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।

মেহেন্দীগঞ্জ পৌরসভার মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কামাল খানকে কোপানোর নির্দেশ দেওয়ার একটি অডিও ক্লিপ ২০২২ সালের জুলাই মাসে বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। মেহেন্দীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) সঙ্গে ওই কথোপকথনের পর তাকে বদলি করা হয়। এই ঘটনায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ এমপির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ কর্মসূচিও করে। এছাড়া, দলীয়  নেতাকর্মীদের পেটানোরও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। বিষয়টি বিভিন্ন গণমাধ্যমেও প্রকাশিত হয়।

নূর মোহাম্মদ: পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক ও কিশোরগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য নূর মোহাম্মদ এবার নৌকার মনোনয়ন পাননি। এবার এই আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন পুলিশের আরেক সাবেক কর্মকর্তা আবদুল কাহার আকন্দ।

বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ছিলেন অবসরে যাওয়া আবদুল কাহার আকন্দ। এ ছাড়া তিনি ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা ও ২০০৯ সালের পিলখানা হত্যা মামলারও তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি হিসেবে চাকরি শেষ করে ২০১৯ সালে অবসরে যান। এরপর থেকে ‍তিনি কিশোরগঞ্জে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হন।

স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে নূর মোহাম্মদের বিরোধের খবর বিভিন্ন সময় সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছিল। মনোনয়ন থেকে বাদ পড়া এটি অন্যতম কারণ বলে মনে করছে  আওয়ামী লীগের একটি সূত্র।

নাঈমুর রহমান দুর্জয়: বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক নাঈমুর রহমান দুর্জয়ও দলীয় মনোনয়ন হারিয়েছেন। এই আসনে এবার মনোনয়ন পেয়েছেন জেলা শাখা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. আবদুস সালাম।

ব্যবসায়ী এনামুল হক:আবাসন ব্যবসায়ী এনামুল হক নানা কারণে আলোচনায় আসেন। ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রেরও ব্যবসা আছে তাঁর। রাজশাহী-৪ আসনের এই সংসদ সদস্য এবার বাদ পড়েছেন। এখানে মনোনয়ন পেয়েছেন আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশবিষয়ক উপকমিটির সদস্য মো. আবুল কালাম আজাদ।

মন্নুজান সুফিয়ান: এবার নৌকার মনোনয়ন পাননি নানা কারণে সমালোচিত  খুলনা-৩ আসনের সংসদ সদস্য বেগম মন্নুজান সুফিয়ান। তিনি বর্তমান সরকারের শ্রম প্রতিমন্ত্রী। এই আসনে এবার নৌকার মাঝি হয়েছেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন।

শওকত হাচানুর রহমান (রিমন): নানা কারণে আলোচিত ছিলেন বরগুনা-২ আসনের সংসদ সদস্য শওকত হাচানুর রহমান (রিমন)। এবার সেখানে মনোনয়ন পেয়েছেন সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য সুলতানা নাদিরা।

ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল:নেত্রকোনা-৫ আসনের সংসদ সদস্য ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল সম্প্রতি সমালোচনায় পড়েন তাঁর স্ত্রী করা এক মামলা নিয়ে। স্নাতকপড়ুয়া এক তরুণীকে প্রধান আসামি করা হয়েছে ওই মামলায়। অভিযোগে বলা হয়, ওই তরুণী সংসদ সদস্যকে অপহরণ, তাঁর স্বাক্ষর জাল ও নাম ভাঙিয়ে টাকা আদায় করা হয়েছে। এই আসনে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেনকে।

মোয়াজ্জেম হোসেন (রতন): হাওরে দখল, দুর্নীতির জন্য সমালোচিত সুনামগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন (রতন) এবার নৌকার মনোনয়ন পাননি। এবার তাঁকে সরিয়ে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে জেলা শাখা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রণজিৎ চন্দ্র সরকারকে।

এছাড়া, নৌকার মনোনয়ন পাননি জমি দখল ও অস্ত্রধারী নিয়ে মিছিল করে সমালোচিত কক্সবাজার-১ আসনের সংসদ সদস্য জাফর আলম। সেখানে মনোনয়ন পেয়েছেন কক্সবাজার জেলা শাখা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সালাহ উদ্দীন আহমদ। এছাড়াও সমালোচিত ও বিতর্কিত হওয়ার কারণে অনেকে বাদ পড়েছেন।

 

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন