অফিসে বা কাজের জায়গায় যে রোগে ভুগছেন প্রায় সকলেই
শরীরের কোনও অঙ্গে ব্যথা হলে অধিকাংশ মানুষ প্রথমেই কী করেন? ব্যথার ওষুধ কিনে খান, তাতে না কমলে চলে যান ডাক্তারের কাছে। ধরুন, কারও হাঁটুতে ব্যথা। ব্যথার ওষুধে না কমলে তিনি অর্থোপেডিক্স’র ডাক্তারের কাছে গেলেন। ডাক্তার ওষুধ দিলেন, ব্যায়াম দেখিয়ে দিলেন, জীবনযাত্রায় কিছু পরিবর্তন আনার কথা বললেন। এভাবেই শুরু হল ব্যথা নিয়েন্ত্রণের ব্যবস্থ্। কিন্তু ব্যথার কারণ কী তা না বুঝেই ওষুধ খেয়ে নেন অনেকে।
লক্ষ করে দেখবেন, অফিসে একটানা বসে কাজ করেন যারা, তাদের বেশিরভাগেরই হয় পিঠে-কোমরে ব্যথা হয় না হলে পায়ের পেশির ব্যথা ভোগায়। সেই সঙ্গে মাথার যন্ত্রণা, অবসন্নভাব, ঝিমুনি ইত্যাদিও দেখা দেয়। এ ধরনের ব্যথা-যন্ত্রণাকে সাধারণ ভেবে খুব একটা পাত্তা দেন না অনেকে। তবে চিকিৎসকেরা বলছেন, এই উপসর্গ কিন্তু ‘ফাইব্রোমায়ালজিয়া’-র লক্ষণ হতে পারে। কী এই ফাইব্রোমায়ালজিয়া? অফিসের চাপ এতটাই যে গ্যাঁট হয়ে বসে কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া গতি নেই। আগে আইটি সেক্টরে কাজের চাপ নিয়ে খুব কথা হত, এখন যে কোনও সেক্টরেই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে গেলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পরিশ্রম করতেই হবে। আর এই একটানা বসে কাজ, অতিরিক্ত মানসিক চাপ বা টেনশনের মধ্যে কাজ অথবা রাত জেগে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কম্পিউটার বা ল্যাপটপের সামনে বসে কাজ করলে একধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। চিকিৎসকরা একে বলছেন ফাইব্রোমায়ালজিয়া। এখনকার প্রজন্ম এই রোগেই ভুগছে বেশি। কোমর-পিঠে ব্যথা, কোমরের নীচের অংশে চিনচিনে ব্যথা, পায়ে ব্যথা, মাথার যন্ত্রণা, অতিরিক্ত ক্লান্তিভাব, অল্প কাজ করলই ঝিমুনি-অবসাদ, যখন তখন মেজাজ বিগড়ে যাওয়া—এইসবই ফাইব্রোমায়ালজিয়ার লক্ষণ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফাইব্রোমায়ালজিয়ার আসল কারণ হল সেডেন্টারি লাইফস্টাইল। শরীরচর্চার অভাব, ভুলভাল খাওয়ার অভ্যাস, তার ওপরে লাগাতার অনিয়ম। একটানা কাজ করে যাওয়া, শরীর নাড়াচাড়া না করার কারণে অস্থিসন্ধি, স্নায়ু , পেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে একইসঙ্গে। ফলে ব্যথা-বেদনা শুরু হচ্ছে। ঘাড়ে বা কাঁধে ব্যথা হলে অনেকেই তা স্পন্ডিলাইটিসের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন। পিঠে বা কোমরে এ ধরনের ব্যথা হলে অনেকেই মনে করেন লোয়ার ব্যাক পেন হচ্ছে, আসলে তা নয়। এগুলি ফাইব্রোমায়ালজিয়ার লক্ষণ হতেই পারে।
হকে পারে যেসব সমস্যা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘ সময় এ ভাবে বসে থেকে কাজ করায় হাঁটুতে ক্ষয় হয়। এমনও দেখা গেছে, খুব কম বয়সেই হাঁটু প্রতিস্থাপনের দিকে যেতে হয়েছে অনেককে। তাছাড়া মাত্রাতিরিক্ত স্ট্রেস মানসিক অবসাদের কারণ হয়ে উঠছে। সমস্যা আরও আছে। একটানা এসিতে বসে থাকা, শরীরে রোদ না লাগানো ইত্যাদির কারণে ভিটামিন ডি-এরও অভাব হচ্ছে শরীরে। ঘাটতি মেটাতে মুঠো মুঠো ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট খেয়ে ফেলে অন্য বিপদ বাঁধিয়ে ফেলছেন অনেকেই। সারাক্ষণ কম্পিউটারে টাইপ করে যাওয়া, অথবা মোবাইল-ল্যাপটপ ব্যবহার করার কারণে হাতের কব্জিতে ট্রায়াঙ্গুলার ফাইব্রোকার্টিলেজ কমপ্লেক্স (টিএফসিসি) হচ্ছে অনেকের। টেনিস এলবোও হতে পারে এ থেকে। ফাইব্রোমায়ালজিয়া একবার দেখা দিলে তার থেকে আরও নানানটা রোগ বাসা বাঁধতে পারে শরীরে। কী করণীয়? কম্পিউটারে কী ভাবে কাজ করছেন, সেটা খুব দরকারি। যে টেবিলে কম্পিউটার রাখা আছে, তার উচ্চতা যেন কোমরের লেভেলে থাকে।
এমন উচ্চতার চেয়ারে বসতে হবে যেন দু’ পায়ের পাতা মাটি স্পর্শ করে থাকে।
সামনে ঝুঁকে বসবেন না। কম্পিউটারের পর্দার সঙ্গে চোখের দূরত্ব এমন রাখুন, যাতে ঘাড় নোয়াতে না হয়।
একভাবে পা ঝুলিয়ে বসে থাকবেন না, মাঝে মধ্যে একটা পায়ের ওপরে অন্য পা তুলে বসুন। চেষ্টা করুন মাঝেমধ্যে বসেই পা নাড়াচাড়া করতে বা পায়ের হাল্কা ব্যায়াম করতে।
মাউস ধরার সময় হাতের কব্জি যেন টেবিলের সাপোর্ট পায় সে দিকেও নজর রাখতে হবে।
প্রতি এক ঘণ্টা অন্তর সিট ছেড়ে উঠুন। যাদের ইতিমধ্যেই হাড়ের অসুখ ধরেছে, তারা একটানা বসে থাকতে গেলে একটা নি-ক্যাপ পরুন।
বাইরে বেরনোর সমস্যা থাকলে ভেতরেই হাঁটাহাঁটি করুন। ঘরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ঘুরে আসুন, সহকর্মীদের সঙ্গে কথাবার্তা, কিছুটা গল্প করে আসুন।
সম্ভব হলে অফিস ডেস্কে স্মাইলি বল রাখুন। কাজের মাঝে পনেরো-বিশ সেকেন্ড ধরে চাপ দিন তাতে। এতে আঙুলের স্টিফনেস কাটবে।
রোজ অন্তত আধঘণ্টা হাঁটুন, দৌড়ন, যোগব্যায়াম সম্ভব হলে করুন। সাঁতার কাটাও খুব উপকারি।
একটানা বসে কাজ করছেন যারা বা অতিরিক্ত টেনশন বা মানসিক চাপে কাজ করতে হচ্ছে, তাদের ধূমপানের অভ্যাস কমিয়ে আনাই ভাল। মাত্রাতিরিক্ত নেশা বিপদ আরও বাড়াবে।