জাতীয়

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে যেভাবে দেখেন কাস্ত্রো-ম্যান্ডেলা

আজ ঐতিহাসিক ৭ মার্চ। ১৯৭১ সালের  এদিনে রমনার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভাষণ দিয়েছিলেন। তাঁর ওই ভাষণে বাংলার মুক্তিপাগল জনতা পেয়েছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহবান।  বিশ্বের যেকয়টি ভাষণ ইতিহাসের গতিপথ পাল্টে দিয়েছে তার মধ্যে অন্যতম বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ।

১৯৭১ সালের এদিন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে)  ভাষণে  কী বলবেন বঙ্গবন্ধু? ৬ মার্চ রাতভর আওয়ামী লীগ দলীয় নেতাদের সঙ্গে আলোচনা শেষে ৭ মার্চ দুপুর পর্যন্তও যখন কোনো ফয়সালা হচ্ছিলো না, তখন বেগম মুজিব পরামর্শ দিলেন, বঙ্গবন্ধুর মনের অজান্তে যা আসে তাই যেনো ভাষণে বলা হয়।

বঙ্গবন্ধুর ডাকে তখন অসহযোগ আন্দোলন চলছিলো। ৭ মার্চ সকাল থেকেই রেসকোর্স ময়দান জনতার সমুদ্র। সমবেত ১০ লাখ লোকের ব্যাকুল প্রতীক্ষা কখন আসবেন কবি। তাদের মুখে একটাই কথা কী বলতে যাচ্ছেন রাজণীতির শ্রেষ্ঠ কবি। স্বাধীনতার ঘোষণা দিচ্ছেনতো?

বিকেল ৩ টা ২০ মিনিট। শরীরে ১০৩ ডিগ্রি জ্বর থাকলেও অদম্য মনোবল নিয়ে দীপ্ত পায়ে মাটি কাঁপিয়ে মঞ্চে ওঠেন মহাকালের মহানায়ক। রচনা করেন কুটনীতির ইতিহাসে কালজয়ী ভাষণ। লাখো মানুষের ভালবাসায় সিক্ত পোয়েট অব পলিটিক্স বজ্রকণ্ঠে শোনান অমর সেই কবিতা।

‘...কি পেলাম আমরা? যে আমার পয়সা দিয়ে অস্ত্র কিনেছি বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য, আজ সেই অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে আমার দেশের গরীব-দুঃখী আর্ত মানুষের বিরুদ্ধে, তার বুকের উপর হচ্ছে গুলী। আমরা পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু। আমরা বাঙালিরা যখনই ক্ষমতায় যাবার চেষ্টা করেছি, তখনই তারা আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছেন.....।’

১৮ মিনিট ৩১ সেকেন্ড স্থায়ী  আর ১১০৮ টি শব্দের এই ভাষণটি ১২টি ভাষায় অনুদিত হয়েছে।  পরের দিন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে এটি প্রচার করে ভাষণটি।  ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ  গণহত্যা শুরু হলে এর কয়েকটি রেকর্ড কলকাতায় পাঠানো হয়।  এপ্রিল মাসে এর তিন হাজার কপি বিনামূল্যে বিতরণ করে বিখ্যাত রেকর্ড কোম্পানি হিজ মাস্টার্স ভয়েজ- এইচএমভি।  মুজিবনগর সরকারও ইংরেজি অনুবাদ করে বহির্বিশ্বে বিতরণ করে।

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের জন্য বঙ্গবন্ধুকে ‘পোয়েট অব পলিটিক্স’ আখ্যা দেয় মার্কিন গণমাধ্যম নিউজউইক। এটি কেবল ভাষণ নয় এটি একটি অনন্য রণকৌশলের দলিল বলে মন্তব্য করেন কিউবার অবিসংবাদিত নেতা ফিদেল কাস্ত্রো। আর বর্ণবাদবিরোধী নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার মতে ‘ ৭ মার্চের ভাষণ আসলে ছিল স্বাধীনতার মূল দলিল।’

ইউনেস্কো বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণকে ডকুমেন্টারি হেরিটেজ" বা বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য) হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।  খ্রিষ্টপূর্ব  ৪৩১ সাল  থকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত সেরা ভাষণগুলো নিয়ে জ্যাকব এফ ফিল্ড সঙ্কলিত  ‘উই শ্যাল ফাইট অন দ্য বিচেস-দ্য স্পিচেস দ্যাট ইন্সপায়ার্ড হিস্ট্রি বইয়ের ২০১ পৃষ্ঠায় ‘দ্য স্ট্রাগল দিস টাইম ইজ দ্যা স্ট্রাগল ফর ইন্ডিপেন্ডেন্স’ শিরোনামে স্থান পেয়েছে বঙ্গবন্ধুর এ্ই ভাষণ।  বিশ্লেষকদের মতে, ১৮৬৭ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সময়ে ইতিহাসের গতিপথ বদলে দেওয়া শীর্ষ পাঁচ ভাষণের মধ্যে রয়েছে  বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১৬তম প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কনের গেটিসবার্গ এড্রেসের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চ ভাষণের তুলনা করে থাকেন অনেকে। ১৮৬৩ সালের ১৯ নভেম্বর পেনসিলভেনিয়ার গেটিসবার্গে দেওয়া লিখিত ভাষণের স্থায়িত্ব ছিলো মাত্র তিন মিনিট। ওই ভাষণের শেষ লাইনটি ছিলো- ‘গভর্নমেন্ট অব দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল’। বিশ্বের সবচেয়ে বহুল পঠিত এবং বহুল উদ্ধৃত বক্তৃতা লিঙ্কনের ওই ভাষণ।

তেমনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চ  অলিখিত ভাষণের শেষ দুটি লাইন ছিলো-‘এবারের্ সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এই দুটি লাইন বিশ্বের মুক্তি ও গণতন্ত্রকামী মানুষের বহুল  পঠিত ও বহুল উদ্ধৃত বক্তৃতা।  এটি শিহরন জাগানোর মতো ভাষণ যা মহাকাব্যের নান্দনিক সৌন্দর্য এবং শব্দের প্রাচুর্য এখনো জনগণকে অনুপ্রাণিত করে।  দিন যতই যাচ্ছে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ  আরও মহিমান্বিত হচ্ছে।

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন