যে সব দেশে সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়া বাধ্যতামূলক
বেশির ভাগ সব দেশ গুলোতে স্ব-ইচ্ছায় যুবক-যুবতী সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। আবার এমনও অনেক দেশ আছে যেখানে একজনের ইচ্ছার বিরুদ্ধেও তাকে পাঠানো হতে পারে সেনাবাহিনীতে। ইচ্ছার বিরুদ্ধে সেই দেশগুলির হাজার হাজার যুবক-যুবতীকে একপ্রকার জোর করেই ঠেলে দেয়া হয় সেনার কাজে।
উত্তর এবং দক্ষিণ কোরিয়া গেলো সাত দশক ধরে একে অপরের সাথে বিরোধিতা করে আসছে প্রায় সব ক্ষেত্রেই। উভয় দেশই বেশি শক্তিশালী হওয়ার দৌড়ে সামরিক শক্তি বাড়িয়েই চলেছে।
উত্তর কোরিয়া এক বিশেষ সামরিক নীতি মেনে চলে, যার নাম ‘সোঙ্গুন’। এই নীতি অনুযায়ী, দেশের মধ্যে থাকা সমস্ত সম্পদের উপর সেনাবাহিনীর অগ্রাধিকার রয়েছে। এই নিয়মের ব্যতিক্রম নন সেই দেশের বাসিন্দারাও। কারণ কিমের দেশ নাগরিকদেরও ‘দেশের সম্পদ’ বলেই মনে করে। মূলত ১৭-১৮ বছর বয়সি সে দেশের স্নাতকদের সেনাদলে যোগদান করানো হয়। আগে মহিলাদের স্বেচ্ছায় সেনাবাহিনীতে যোগদান করার নিয়ম থাকলেও ২০১৫-র পর থেকে মহিলাদেরও সেনাবাহিনীতে যোগদান বাধ্যতামূলক করা হয়। ২০০৩ সালে, পুরুষদের কমপক্ষে ১০ বছর এবং মহিলাদের কমপক্ষে সাত বছর সেনাবাহিনীতে পরিষেবা দেয়া বাধ্যতামূলক করা হয়। তবে তার আগে পুরুষদের জন্য এই সময়সীমা ছিল ১৩ বছর এবং মহিলাদের জন্য ১০ বছর।
দক্ষিণ কোরিয়াতেও পুরুষদের সেনায় যোগ দেয়া বাধ্যতামূলক। পুরুষদের ২১ মাস সেনাবাহিনীতে বা ২৩ মাস নৌবাহিনীতে বা ২৪ মাস বিমানবাহিনীতে যুক্ত থাকা বাধ্যতামূলক। তবে কেউ চাইলে বিকল্প হিসেবে পুলিশ ও দমকলেও যোগ দিতে পারেন। তবে সফল ক্রীড়াবিদরা এই দায় থেকে অব্যাহতি পেতে পারেন।
রাশিয়ায় সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার নিয়ম বেশ কঠিন। সদ্য সেনাদলে যোগ দেয়া সদস্যদের প্রায়শই উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নির্যাতন সহ্য করতে হয় বলে অভিযোগ। সে দেশে এই প্রক্রিয়া ‘হ্যাজিং’ নামে পরিচিত। তবে রাশিয়া অন্য দেশের সাথে সামরিক সঙ্ঘাতের সময় প্রশিক্ষণ না-পাওয়া সৈন্যদের ব্যবহার করে বলেও দুর্নাম রয়েছে। ইউক্রেন এবং চেচনিয়ার সঙ্গে রাশিয়ার যুদ্ধ এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
নিয়ম অনুযায়ী, রাশিয়ার ১৮ থেকে ২৭ বছর বয়সী পুরুষদের ১২ মাসের জন্য সেনায় যোগ দেয়া বাধ্যতামূলক। এই নির্দেশ অমান্য করলে জরিমানা বা কারাদণ্ডও হতে পারে।
ব্রাজিলের সংবিধান অনুযায়ী দেশের সমস্ত পুরুষের জন্য সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়া আবশ্যক। সর্বনিম্ন ১২ মাসের জন্য সামরিকবাহিনীতে যুক্ত থাকতে হয় সে দেশের পুরুষদের। তবে কেউ চাইলে আট বছর পর্যন্ত নিজের ইচ্ছায় সেনায় যুক্ত থাকতে পারেন। ব্রাজিলে সাধারণত ১৮ বছর বয়স পেরোলেই যুবকদের সেনায় ভর্তি করানো হয়। বাহিনীতে যোগ দিতে অনিচ্ছুকদের ভোটাধিকার কেড়ে নেয়ারও আইন রয়েছে। তবে সেনাদলে যোগ দেয়ার এই নিয়ম থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে মহিলাদের।
১৯৪৯ সালের ইসরায়েলের নিরাপত্তা পরিসেবা আইন অনুযায়ী আরবের ইসরায়েলিরা ছাড়া বাকি সব ১৮ বছর বয়সি ইসরায়েলির সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়া বাধ্যতামূলক। নিরাপত্তা বাহিনীতে যোগ দিতেই হবে ইহুদি, ড্রুজ বা সার্কাসিয়ান বংশোদ্ভূত ইসরায়েলিদের। পুরুষদের কমপক্ষে দু’বছর আট মাস এবং মহিলাদের দু’বছর সেনায় যুক্ত থাকার বিধি রয়েছে সে দেশে।
আরবের ইসরায়েলি ছাড়াও বিবাহিত এবং শারীরিক ও মানসিক ভাবে অসুস্থদের সেনাদলে যোগ দেওয়ার নিয়ম থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। সমীক্ষা অনুযায়ী, ইজরায়েলি পুরুষদের একাংশ এই নিয়মের অবসান চান। তারা বরং স্বেচ্ছায় সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার পক্ষে।
ইরানের সংবিধান অনুযায়ী, ১৮ বছর পেরোলেই সে দেশের যুবকদের দেড় থেকে দু’বছরের জন্য সেনাবাহিনীতে যোগ দিতেই হবে। তবে মহিলাদের জন্য নিরাপত্তা বাহিনীতে যোগ দেওয়া বাধ্যতামূলক নয়। এ ছাড়া শারীরিক অসুস্থতা থাকলেও এই নিয়ম থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। ১৮ বছরের যুবকদের বাবার বয়স ৬০ বছরের বেশি হলে তারাও এই নিয়ম থেকে অব্যাহতি পাবেন। সেনায় যোগ দেওয়ার নিয়ম না মানলে ওই যুবক ভয়ানক সাজার মুখোমুখি হতে পারেন।
এই বছরেরে শুরুতে ইরান সরকার নতুন নিয়ম আনার প্রস্তাব দেয়। সেখানে ১০ হাজার ডলারের পরিবর্তে ৩৫ বছরের বেশি বয়সি পুরুষরা সেনায় যোগ দেয়া থেকে ছাড় পেতে পারেন। তবে এই সিদ্ধান্ত নিয়ে ব্যাপক উত্তেজনা ছড়ানোয় এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয়নি। বিক্ষোভকারীদের দাবি ছিল, সরকারের এই সিদ্ধান্তের ফলে ধনীদের সুবিধা হবে।
কিউবাতে ১৭ থেকে ২৮ বছর বয়সি পুরুষদের দুই বছর দেশের সামরিকবাহিনীতে যোগ দেওয়া বাধ্যতামূলক। ১৬ বছর হলেই তাদের সে দেশের সেনাদলে নাম নথিভুক্ত করতে হয়। দুই বছর পরিসেবা দেয়ার পর পুরুষরা সেনাবাহিনী ছেড়ে চলে গেলেও তাদের সেনার অংশ হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। ৪৫ বছর বয়স হওয়া পর্যন্ত দেশের স্বার্থে যখন খুশি আবারও সেনায় যোগ দেয়ার নির্দেশ দেয়া হতে পারে ওই ব্যক্তিদের। সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে অস্বীকার করলে সেই ব্যক্তির কারাদণ্ড বা জরিমানাও হতে পারে। তবে মহিলাদের ক্ষেত্রে নিয়মটা একটু আলাদা। মহিলারা স্বেচ্ছায় দুই বছরের জন্য সেনা হিসেবে যোগ দিতে পারেন। তবে যোগ দিতেই হবে এমন বাধ্যবাধকতা নেই।
সুইজারল্যান্ডেও পুরুষদের নিরাপত্তা বাহিনীতে যোগ দেয়া বাধ্যতামূলক। সে দেশে পুরুষদের ২০ বছর বয়সের পর থেকে সেনায় যোগ দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। দুই বছরের কিছু কম সময় পুরুষদের সেনাবাহিনীতে যুক্ত থাকা বাধ্যতামূলক। তবে মহিলারা যোগ দিতে পারেন নিজেদের ইচ্ছায়।
পুরুষদের অতি অবশ্যই সেনাদলে যোগ দেওয়ার এই নিয়ম বদলানোর জন্য ২০১৩ সালে সুইজারল্যান্ডে গণভোট হয়। তবে ৭৩ শতাংশ মানুষ পুরুষদের প্রতিরক্ষা বাহিনীতে আবশ্যিক ভাবে যোগ দেয়ার পক্ষেই ভোট দেন। এর আগেও দুই বার এই গণভোটের আয়োজন করা হয়েছিল। পুরুষদের জন্য নিয়ম তো পাল্টানো তো দূরে থাক, উল্টে ২০২৪ সালের মধ্যে মহিলাদেরও সামরিকবাহিনীতে যোগদান বাধ্যতামূলক করার চিন্তাভাবনা চলছে।
তুরস্কেও ২০ থেকে ৪১ বছর বয়সি পুরুষদের নিরাপত্তা বাহিনীতে যোগদান বাধ্যতামূলক। তবে ২০১৯ সালে সে দেশের আইনসভায় একটি নতুন আইন পাশ করে সেনাবাহিনীতে পরিষেবার সময়সীমা ১২ মাস থেকে কমিয়ে ছয় মাস করা হয়েছে। তবে কেউ চাইলে এর পরেও নিজের ইচ্ছায় সেনাবাহিনীতে থাকতে পারেন। তবে কেউ সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে না চাইলে তার বিকল্পও রয়েছে। এক মাসের সামরিক প্রশিক্ষণের পর কেউ চাইলে পাঁচ হাজার ডলারের বিনিময়ে বাকি পাঁচ মাস সেনাবাহিনীতে কাজ করা এড়াতেও পারেন। তবে কেউ যদি উচ্চশিক্ষার জন্য সেনাবাহিনীতে দেরিতে যোগ দিতে চান, তা হলে তাকে সেই অনুমতি দেয়া হয়। প্রবাসী তুর্কিরাও সরকারকে নির্দিষ্ট অর্থপ্রদান করে সেনাদলে যোগ দেয়া থেকে অব্যাহতি পেতে পারেন।
২০১০ সালে সুইডেনে পুরুষদের আবশ্যিক ভাবে সেনাদলে যোগ দেয়ার নিয়ম বাতিল করা হলেও ২০১৭ সালে তা আবার ফিরিয়ে আনা হয়। তবে ২০১৪ সালে ক্রাইমিয়া রাশিয়ার দখলে যাওয়ার পর পরই সুইডেনে আবারও সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়া বাধ্যতামূলক করার বিষয়ে চিন্তাভাবনা শুরু হয়। তবে আগে শুধু পুরুষদেরই সেনাতে যোগ দেওয়া বাধ্যতামূলক থাকলেও ২০১৭ সালের পর পুরুষ এবং মহিলা উভয়ের জন্যই সেনাবাহিনীকে যোগ দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়। সেনায় আবশ্যিক ভাবে যুক্ত থাকার সময়কাল ৯ থেকে ১২ মাস।
উত্তর-পূর্ব আফ্রিকার দেশ এরিট্রিয়া সেনায় নিয়োগের নিয়মের জন্য কুখ্যাত। মানবাধিকার কমিশনের মতে, এই দেশের অনেক বাসিন্দা তাদের পুরো জীবন অনিচ্ছা সত্ত্বেও সামরিক বাহিনীতে কাটিয়েছেন। ২০০৩ সালে সরকারের তরফে নির্দেশ দেওয়া হয়, স্কুলশিক্ষা শেষ করার আগে ছেলে এবং মেয়ে উভয়ের জন্যই সামরিক প্রশিক্ষণ নেওয়া বাধ্যতামূলক।
এরিট্রিয়ার এই আইন অনুযায়ী, কমপক্ষে ১৮ মাস সেনাবাহিনীতে যুক্ত থাকতেই হবে। তবে সে দেশের অনেক বাসিন্দাকেই আজীবন সেনায় কাজ করে যেতে হয়। রিপোর্ট অনুযায়ী, এই আইনের হাত থকে বাঁচতে ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়সি অনেক যুবক-যুবতীই দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান।
২০০০ সালে ইথিয়োপিয়ার সঙ্গে সীমান্তবর্তী যুদ্ধের সময় এরিট্রিয়ায় এই নিয়ম চালু করা হয়। কিন্তু ২০১৮ সালে ইথিয়োপিয়ার সাথে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পরও এরিট্রিয়া সরকার এই আইনে কোনও বদল আনেনি।