অবন্তিকার আত্মহত্যা : যে ব্যাখ্যা দিলেন অভিযুক্ত শিক্ষক
শিক্ষক ও সহপাঠীকে দায়ী করে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ফাইরুজ অবন্তিকা। এ ঘটনায় উত্তাল জবি। এবার অভিযুক্ত শিক্ষক সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম অভিযোগের প্রেক্ষিতে তাঁর ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেছেন।
শনিবার (১৬ মার্চ) একটি গণমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে অভিযুক্ত শিক্ষক দ্বীন ইসলাম এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
মৃত্যুর পূর্বে ফেসবুকে দেয়া অবন্তিকার স্ট্যাটাস এর প্রেক্ষিতে দ্বীন ইসলাম বলেন,
১. প্রথমত আমার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ,আম্মানকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করা, যা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। কারণ ঘটনা নিষ্পত্তি হয় ১৬.০৮.২০২২ সালে। এরপর এ বিষয়ে আর কারো সাথে কোনো আলোচনা হয়নি কখনোই।
২. প্রক্টর অফিসে অবন্তিকা ও তার মাকে একবারই ডাকা হয়েছিল। সেই সময় প্রক্টর মোস্তফা কামাল স্যার, সহকারী প্রক্টর গৌতম সাহা স্যার এবং অভিযোগকারী তার বন্ধুরা উপস্থিত ছিলেন। একাধিকবার ডেকে হেনস্তা করার বিষয়টি সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং ভিত্তিহীন। কারণ বিষয়টি ওইদিনই মীমাংসা হয়ে গিয়েছিল।
৩. সুইসাইড নোটে প্রক্টর অফিসে আম্মানের বিরুদ্ধে আনিত যৌন হয়রানি ও ভয়ভীতির অভিযোগের বিচার না পাওয়ার বিষয়টি তৎকালীন প্রক্টর মোস্তফা কামাল স্যার ভালো বলতে পারবেন। এ অভিযোগ সম্পর্কে আমি অবগত নই।
৪. সুইসাইড নোটে আনিত অভিযোগ অবন্তিকাকে বহিষ্কার করার বিষয়ে পরবর্তীতে আমি কখনো কিছুই বলিনি। কারণ বিষয়টি মীমাংসা হওয়ার পর বিগত দেড় বছরে একবারের জন্যও অবন্তিকা বা তার পরিবারের সাথে আমার কোনো কথা বা যোগাযোগ হয়নি।
অভিযুক্ত শিক্ষক দ্বীন ইসলামের দাবি
১. একজন শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীদের পাশে থাকা এবং তাদের জন্য কাজ করা আমার নৈতিক দায়িত্ব। দীর্ঘ ১১ বছরের শিক্ষকতার জীবনে আমি আমার সর্বোচ্চটুকু দিয়ে শিক্ষার্থীদের পাশে ছিলাম, ইনশাল্লাহ ভবিষ্যতেও থাকব।
২. শুধু স্ট্যাটাসের ওপর ভিত্তি করে কাউকে ভুল না ভাবার অনুরোধ রইল।
৩. এ অপ্রত্যাশিত ঘটনার প্রকৃত রহস্য উন্মোচনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ও অন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করার জন্য আমি সবিনয়ে প্রস্তুত।
অবন্তিকার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে দ্বীন ইসলাম তাঁর নিম্নোক্ত বক্তব্যে দাবি করেন,
ঘটনা প্রায় দেড় বছর আগের। অবন্তিকার ব্যাচমেটরা কোতোয়ালি থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করে, সেখানে অবন্তিকাও উপস্থিত ছিল। জিডিতে উল্লেখ করা হয় যে, কেউ একজন ফেসবুকে ভুয়া অ্যাকাউন্ট খুলে তাদের হয়রানি করে। পুলিশ তখন উচ্চতর তদন্তের আশ্বাস দিয়ে বলে আগামী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে আইডিটা কে চালায় সেটা বের করে দেব। এ কথা শুনে অবন্তিকা থানা থেকে বের হয়ে ক্যাম্পাসে আসার পথেই তার বন্ধুদের কাছে স্বীকার করে যে আইডিগুলো (ফেক অ্যাকাউন্টগুলো) সে নিজেই চালায়। তখন তার বন্ধুরা তাকেসহ প্রক্টর অফিসে নিয়ে অবন্তিকার বিরুদ্ধে গত ০৮.০৮.২০২২ইং তারিখে একটা লিখিত অভিযোগ দেয়।
অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন প্রক্টর মোস্তফা কামাল স্যার আমাকে ও সহকারী প্রক্টর গৌতম কুমার সাহা (গণিত বিভাগ) স্যারকে গত ১১.০৮.২০২২ইং তারিখে তদন্তের দায়িত্ব দেন। পরবর্তীতে গত ১৬.০৮.২০২২ইং তারিখে প্রক্টর স্যারের উপস্থিতিতে আমি ও সহকারী প্রক্টর গৌতম কুমার সাহা অবন্তিকা ও অবন্তিকার অভিভাবকদের প্রক্টর অফিসে আসার জন্য আহ্বান করি। পরে অবন্তিকার মা মিটিংয়ে আসে এবং এখানে অবন্তিকার ক্লাসমেটসহ (অভিযোগকারীরা) সবাই উপস্থিত ছিল। তখন অবন্তিকার মা তার ব্যাচমেট (যারা অভিযোগ করেছে) তাদের কাছে ঘটনার সত্যতা শুনে বলে যে আমার মেয়ে যা করেছে ভুল করেছে। ঘটনার জন্য তিনি অভিযোগকারী সবার কাছে আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করেন এবং ভবিষ্যতে তার মেয়ে আর এ ধরনের কাজ করবে না বলে প্রতিশ্রুতি দেন এবং বলেন, যদি করে তার দায় আমরা নেব। এবারের মতো বিষয়টি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার জন্য অনুরোধ জানান এবং বলেন, আমার মেয়ে ভালো শিক্ষার্থী কিন্তু সে কয়েকদিন ধরে মানসিকভাবে অসুস্থ ও ওষুধ খাচ্ছে।
তখন তার ব্যাচমেটরা বিষয়টা মানবিক ও ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখেন। এভাবে বিষয়টা প্রাথমিকভাবে মীমাংসা করা হয়। মীমাংসার পর অবন্তিকার মা জিডিটা তুলে নেওয়ার জন্য অভিযোগকারীদের বারবার অনুরোধ করেন। কিন্তু অভিযোগকারীরা জিডি তুলে নিতে অসম্মতি জানায়, কারণ তাদের ধারণা অবন্তিকা ভবিষ্যতে এ ধরনের আচরণ আবারও করতে পারে।
তখন আর জিডিটা সাথে সাথেই তোলা সম্ভব হয়নি। অভিযোগকারীরা বলেন, আমরা তাকে আগামী ৩ মাস পর্যবেক্ষণ করব এবং যদি অবন্তিকা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে তাহলে আমরা ৩ মাস পরে জিডিটা তুলে নেব। ঝামেলা এখানেই প্রাথমিকভাবে নিষ্পত্তি করা হয়। এর কিছুদিন পরে অবন্তিকা ও তার মা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন এবং আমাকে প্রক্টর অফিসে না পেয়ে আমার বিভাগে আসেন, যেহেতু আমার এলাকার আমি তাদের আমার সাধ্যমতো আপ্যায়ন করি। যেহেতু তিনি আমার এলাকার এবং তিনি একজন অভিভাবক, আমি আমার জায়গা থেকে সর্বোচ্চটুকু দিয়ে আপ্যায়ন করি। ওইদিন অবন্তিকার মা আমাকে জানান অবন্তিকার হলের বন্ধুরা ওর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করছে না। এতে অবন্তিকা মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছে। তখন আমি তাদের প্রক্টর অফিসে লিখিতভাবে অভিযোগ করার পরামর্শ দিই। তখন অবন্তিকার মা বলেন, যা হওয়ার হয়ে গেছে এখন আর এ বিষয় নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে চাইছি না এবং বলেন, আমি আমার মেয়েকে হলে রাখব না। এতে করে তার পড়াশোনা খারাপ হয়ে যাবে এবং সে মানসিকভাবে আরও ভেঙে পড়বে। তখন আমি তাকে বলি, আপনি অভিভাবক যা ভালো মনে করেন সেটাই করেন। যেকোনো প্রয়োজনে আমার সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে। অভিযোগ নিষ্পত্তির ৩ মাসেরও কিছুদিন পরে অবন্তিকা এবং তার বাবা-মা প্রক্টর অফিসে জিডি তোলার জন্য আসেন কিন্তু তার ব্যাচমেটরা জিডি তুলতে অসম্মতি জানান। তখন অবন্তিকার মা-বাবা এবং অবন্তিকা আবার আমাকে ফোন করে আমার বিভাগে দেখা করতে আসে।
আমি তখন ক্লাস নিচ্ছিলাম এবং পরে ক্লাস থেকে বের তাদের আমার রুমে নিয়ে আমার সাধ্যমতো আপ্যায়ন করি। তখন তারা জিডি তোলার বিষয়ে আমাকে অনুরোধ করেন। আমি তখন তাদের বিষয়টা বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করি যে বিষয়টা আমার হাতে নেই। আমাদের কাজ তদন্ত করে রিপোর্ট প্রদান করা এবং আমরা তাই করি। জিডির বিষয়ে প্রক্টর স্যার ও অভিযোগকারীদের সাথে আলাপ করে নিষ্পত্তি করার পরামর্শ দিই।
তৎক্ষণাৎ অবন্তিকার মা কিছুটা হতাশার ভাষায় বলেন, আমি দুজন (অবন্তিকা ও ওর বাবা) ডিপ্রেশনের রোগীকে নিয়ে এত বছর সংসার করে আসছি। আমি নিজেও অনেক অসুস্থ হয়ে পড়ছি। এবং বলেন, আমার মেয়েটা মারাত্মক ডিপ্রেশনে পড়ে গেছে। এরপর অবন্তিকা ও তার পরিবারের কারো সঙ্গে এ বিষয়ে আজ পর্যন্ত আমার কোনো যোগাযোগ হয়নি।
প্রসঙ্গত,গত শুক্রবার (১৫ মার্চ) রাতে সহকারী প্রক্টর ও আম্মান সিদ্দিকী নামে এক সহপাঠীকে দায়ী করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে ফ্যানের সঙ্গে ওড়না পেঁচিয়ে গলায় ফাঁস নেন ফাইরুজ অবন্তিকা নামে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের এক ছাত্রী।