আন্তর্জাতিক

প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ‘পেজেশকিয়ান ম্যাজিক’, সংস্কারের পথে ইরান?

যুদ্ধবিরোধী মনোভাব পরিহার করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখার প্রতিশ্রতি দিয়ে ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়াইয়ে নামেন তিনি। প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ইরানে একটি বাস্তবসম্মত পররাষ্ট্রনীতি, রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি এবং মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় জর্জরিত অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করার। তার ডাকে সাড়া দিয়েছেন ইরানের সংস্কারপন্থীরা।  তাইতো জনগণের সমর্থন পেয়েই নির্বাচনে শেষ হাসি হাসলেন মাসুদ পেজেকশিয়ান।

মাসুদ পেজেশকিয়ান বরাবরই সংস্কারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। তবে গত দুই বছর ধরে হিজাবসহ বিভিন্ন ইস্যুতে সরকারের বিরুদ্ধে তার আওয়াজ জোরালো হতে শুরু করে। কট্টরপন্থীদের ব্যাপক নির্বাচনী প্রচারণার মাঝে নারীর অধিকার, অধিক সামাজিক স্বাধীনতা, পশ্চিমের সঙ্গে বৈরিতায় সতর্কতা ও অর্থনৈতিক সংস্কারের প্রতি সমর্থন জানিয়ে ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নেন মধ্যপন্থী এই নেতা।

শুক্রবারের নির্বাচনে কট্টরপন্থী সাঈদ জালিলির চেয়ে প্রায় ৩০ লাখ ভোট বেশি পেয়েছেন ইরানের বিশিষ্ট এই হার্ট সার্জন। পেজেশকিয়ান পেয়েছেন ১ কোটি ৬৩ লাখ ভোট পেয়েছেন। যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বী জালিলির বাক্সে পড়েছে ১ কোটি ৩৫ লাখ ভোট। গেলো ২৮ জুন অনুষ্ঠিত নির্বাচনে চার প্রার্থীর কেউ এককভাবে ৫০ ভাগের বেশি ভোট না পাওয়ায় নির্বাচন রান অফে গড়ায়। নির্বাচনে সাবেক দুই সংস্কারপন্থী প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ খাতামি ও হাসান রুহানিরও সমর্থন পেয়েছেন তিনি।

বছর কয়েক আগেও ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির অনুগত থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে পেজেশকিয়ান তাঁর কড়া সমালোচক বনে যান। পেজেশকিয়ান প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় সংস্কারপন্থিরা আশার আলো দেখছেন। যুদ্ধ নয় শান্তি, পশ্চিমা অবরোধ আর নয়,সবার সঙ্গে বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক হবে-এমন স্বপ্ন দেখছেন দেশটির সংস্কারপন্থিরা।

৬৯ বছর বয়সী এই রাজনীতিক একাধিকবার ইরানের সমাজ ব্যবস্থার সমালোচনা করেছেন। সোচ্চার হয়েছেন ইরানের নৈতিকতা পুলিশের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে। ইরান থেকে হিজাব আইন প্রত্যাহারের প্রতিশ্রুতি ছিলো তার নির্বাচনী প্রচারণায়। এমনকি পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকের আশ্বাসও দিয়েছিলেন দেশটির সাবেক এই স্বাস্থ্যমন্ত্রী।

তাই সংস্কারপন্থীদের আশা অনেক। তাদের এই আশা পূরণ করতে পারবেন তো মাসুদ পেজেশকিয়ান? কী ভাবছেন বিশ্লেষকেরা।? বিশ্লেষকদের অনেকেই ধারণা করছেন, ইরানের অর্থনীতির উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে এবং পশ্চিমের সাথে উত্তেজনা কমানোর জন্য পুনরায় পরমাণু চুক্তি পুনর্বিবেচনা করবেন নতুন এই নেতা।

বিশ্লেষকদের অনেকেই আবার মনে করছেন,ইরানে সংস্কারপন্থী প্রেসিডেন্ট ক্ষমতায় আসলেও ইরানের পররাষ্ট্রনীতিতে উল্লেখযোগ্য সংস্কার বা পরিবর্তন হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। তাদের মতে,মাসুদ পেজেশকিয়ান নির্বাচনে জিতেছেন ঠিকই, কিন্তু তার মানে এই নয় যে তিনি দেশের দিক পরিবর্তন করার ক্ষমতা পাবেন।

বিশ্লেষকদের এমন ধারণার পেছনে শক্তিশালী যুক্তিও রয়েছে।  কারণ ১৯৮৯ সাল থেকে ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি।  ইরানের যেকোন বিষয়ে মূলত সিদ্ধান্ত নেন তিনি। এছাড়া তিনিই দেশটির সামরিক বাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ। দেশটির সরকারি পুলিশ ও নীতি পুলিশের কর্তৃত্বও খামেনির হাতে।

শুধু তাই নয়, ইরানের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্বে থাকা ইসলামিক রেভল্যুশন গার্ড কর্পস-আইআরজিসি’র নিয়ন্ত্রণও আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির হাতে। এছাড়া, সিরিয়া, লেবানন, ফিলিস্তিনে ইরানের প্রক্সিগ্রুপগুলোও নিয়ন্ত্রণ করেন ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা।  এমনকি, পার্লামেন্টে কোনো আইন পাশ হলে সেই আইন অনুমোদন বা বাতিল ঘোষণার ক্ষমতাও রাখেন ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা। কোনো দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনার ঘোষণাও তার মাধ্যমে হয়ে থাকে।

তবে ইরানের প্রেসিডেন্ট দেশটির শীর্ষ নির্বাচিত কর্মকর্তা।  সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার পরই তার অবস্থান। সরকারের কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব তার ওপর। ইরানের অভ্যন্তরীণ নীতি ও পররাষ্ট্রনীতির বিষয়ে তার গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব থাকলেও তার ক্ষমতা বিশেষ করে নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট ইস্যুতে অনেক সীমিত। তারা মনে করছেন, সংস্কার আনতে হলে ইরানের পার্লামেন্টে আধিপত্য বিস্তারকারী অতি-রক্ষণশীল শক্তির মুখোমুখি হতে হবে মাসুদ পেজেশকিয়ানকে।

এমআর//

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন