বাংলাদেশিদের ভালোবাসায় আপ্লুত তুরস্ক
তুরস্ক-বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক ছাড়াও সাধারণ মানুষের ভালোবাসাও সীমানা ছাড়িয়েছে। তুরস্কের ভয়াবহ ভূমিকম্পে সামর্থ্য অনুযায়ী পাশে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। এছাড়া তুরস্কে অবস্থান করা বাংলাদেশিরাও তুর্কিদের সঙ্গে এই বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। তুর্কি গণমাধ্যমেও তুরস্কের প্রতি বাংলাদেশের ভালোবাসার কথা ফুটে উঠেছে।
তুরস্কে দিনরাত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া উদ্ধারকারী দল। এরই মধ্যে জীবিত ও মৃতদের উদ্ধার করেছে তারা। তাদের সাহসিকতার খবরও ফলাও করে প্রচার করেছে তুরস্কের সংবাদমাধ্যম।
ধ্বংসস্তূপে অনুসন্ধান ও উদ্ধারকাজে অংশ নিতে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ১২ সদস্যসহ মোট ৭০ সদস্যের একাধিক দল তুরস্কে পৌঁছেছে। এছাড়া মেডিকেল টিমও দেশটিতে তাদের কার্যক্রম শুরু করেছে।
তুরস্কের সরকারি সংবাদ সংস্থা আনাদুলু এজেন্সি বাংলাদেশের সহায়তা ও বাংলাদেশিদের ভালোবাসার বিষয়ে একাধিক খবর প্রকাশ করেছে।
'জোড়া ভূমিকম্পের পর তুরস্কের সঙ্গে বাংলাদেশিদের সংহতি' শীর্ষক শিরোনামে তুর্কিদের প্রতি বাংলাদেশিদের ভালোবাসা ফুটে উঠেছে। প্রত্যন্ত উত্তর সীমান্ত জেলা পঞ্চগড়ের একজন রিকশাচালক মোহাম্মদ আজগরের কথা তুলে ধরা হয়েছে। ভূমিকম্পের বিষয়ে জানতে চাইলে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন ঢাকার এই রিকশাচালক।
আনাদুলু এজেন্সিকে তিনি বলেন, 'তারা (তুর্কি ও সিরিয়ার নাগরিকরা) আমাদের ভাই-বোন। তাদের কষ্ট মানেই আমাদের কষ্ট। যেহেতু আমি একজন দরিদ্র মানুষ, তাই তাদের দান করার ক্ষমতা আমার নেই। কিন্তু আমি আল্লাহর কাছে তাদের সাহায্য করার জন্য প্রার্থনা করেছি।'
পাশে মোহাম্মদ কালাম আজগর বড় একটি কম্বল নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি ময়মনসিংহ থেকে একটি বড় কম্বল নিয়ে তুর্কি জনগণকে তীব্র ঠাণ্ডা থেকে সহায়তা করতে এসেছেন। কালাম আজগর বলেন, 'আমি দুঃখিত এবং হতবাক হয়েছি যখন আমি সামাজিক মাধ্যমে দেখি যে তুরস্কে দুর্যোগের মধ্যে শিশুসহ লোকেরা তীব্র ঠাণ্ডায় ভুগছে। আমার সর্বোত্তম ক্ষমতা দিয়ে আমি এই ভারী কম্বলটি তুরস্কের যেকোনও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে দান করার জন্য কিনেছি।'
পরে ওই ব্যক্তি ঢাকার গুলশানে অবস্থিত তুর্কি সহযোগিতা ও সমন্বয় সংস্থার (টিকা) সদর দফতরে কম্বলটি হস্তান্তর করেন।
কালামের মতো শনিবার বাংলাদেশের বিভিন্ন দূরবর্তী অঞ্চল থেকে শত শত বাংলাদেশী নাগরিক দেশের রাষ্ট্রীয় সংস্থার মাধ্যমে বিপর্যয়কর তুর্কি জনগণকে সহায়তা করার জন্য গরম কাপড়, শুকনো খাবারের মতো প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দান করতে ঢাকার টিকা অফিসে এসেছিলেন।
চাঁদপুরের একজন গৃহিণী সাবিনা ইয়াসমিন ফোনে আনাদুলুকে বলেন, 'সোমবার তুরস্কে বিধ্বংসী ভূমিকম্পের পর থেকে, আমি ঠিকভাবে ঘুমাতে পারি না। ধ্বংসের দৃশ্য এবং কোমল শিশুসহ ক্ষতিগ্রস্তদের অসহায় মুখগুলো সবসময় মনে ভেসে ওঠে। আমি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি।'
টিকা সেভকি মের্ট বারিসের বাংলাদেশের সমন্বয়কারী বলেছেন যে, বাংলাদেশি অনুদানের প্রথম চালান ইতোমধ্যেই তুরস্কে পৌঁছেছে। বারিস বলেন, 'আমাদের প্রথম তুর্কি এয়ারলাইন্স বাংলাদেশিদের দান করা প্রায় ৫ টন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে শনিবার সকালে তুরস্কে পৌঁছেছে এবং আমরা আশা করছি যে আজ রাতে (শনিবার) প্রায় ১০ টনের আরেকটি চালান পৌঁছাবে।'
তুরস্কের দুর্যোগে বাংলাদেশি নাগরিকদের অপ্রতিরোধ্য প্রতিক্রিয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করে তিনি আরও জানান যে, তুর্কিয়ের কার্গো এয়ারলাইন্স আজ রাতে (শনিবার) বাংলাদেশে আসবে এবং আশা করছি বাংলাদেশ থেকে ১০০ টন ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে তুরস্কের উদ্দেশ্যে যাত্রা করবে।
তিনি বাংলাদেশ সরকারকে ১০ হাজার তাঁবু দান করার জন্য ধন্যবাদ জানান যা ভূমিকম্প বিধ্বস্ত তুরস্কের জনগণের জন্য অপরিহার্য।
'তুরস্কের ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায় বাংলাদেশিরা' শিরোনামের আরেক খবরে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের মানুষ ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য করার জন্য উদারভাবে অনুদান দিয়ে আসছে।
ঢাকায় টিকা অফিসের সমন্বয়কারী সেভকি মের্ট বারিস আনাদোলুকে বলেন, 'বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ জনগণের সমর্থনে আমরা আপ্লুত।
সহায়তার জন্য বাংলাদেশকে ধন্যবাদ জানিয়েছে তুরস্কের রাষ্ট্রদূত। সেই খবরও প্রকাশ করেছে আনাদুলু।
তুরস্কের জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যম হুররিয়াত ভূমিকম্পের হতাহতদের জন্য বাংলাদেশের একদিনের শোক পালনের বিষয়টি ফলাও করে প্রকাশ করেছে। এমন ঘটনার জন্য বাংলাদেশের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানো হয়েছে। একই বিষয়ে খবর প্রকাশ করেছে দেশটির অন্যতম অনলাইন সংবাদমাধ্যম সনদাকিকা।
এছাড়া সরকার ঘনিষ্ঠ ইয়েনি শাফাক পত্রিকাও ভূমিকম্পে বাংলাদেশের তৎপরতা ও উদ্ধারকারী দল পাঠানোর খবরটি গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করেছে।
এছাড়া তুরস্কের প্রায় সকল পত্রিকা, টেলিভিশন ও অনলাইন সংবাদমাধ্যম বাংলাদেশের সহায়তা ও বাংলাদেশিদের সহমর্মিতার বিষয়টি ফলাও করে প্রকাশ করেছে।
গত সোমবার (৬ ফেব্রুয়ারি) হওয়া দুটি শক্তিশালী ভূমিকম্পে এখন পর্যন্ত প্রায় ৩০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। তুরস্কে প্রায় ৭০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। সেখানে এখনও আটকা রয়েছে হাজার হাজার মানুষ। মৃত্যুর সংখ্যা আরও অনেক বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশ ছাড়াও বিশ্বের ৭০টিরও বেশি দেশ ও সংস্থা তুরস্ক ও সিরিয়ার উদ্ধার-কার্যক্রমে অংশ নিয়েছে। এছাড়া প্রয়োজনীয় সামগ্রী ত্রাণ হিসেবে দেশটিতে পাঠানো হয়েছে। তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান বলেছেন, সবার সঙ্গে মিলে এই সংকট কাটিয়ে উঠবেন তারা।