নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাব্বির আলম খন্দকার হত্যা মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়েছে। অজানা কারণে ২০ বছর এ মামলার বিচারিক কার্যক্রম বন্ধ থাকলেও সম্প্রতি সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হওয়ায় খুশি স্বজনরা। দেরিতে হলেও ন্যায় বিচার চান তারা।
এর আগে ২০০৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি শহরের মাসদাইর এলাকার বাসার সামনে দুর্বৃত্তদের গুলিতে নিহত হন সাব্বির আলম খন্দকার। তিনি বাংলাদেশ নিট ম্যানুফ্যাকচারাস অ্যান্ড এক্সপোর্টারস অ্যাসোশিয়েসনের (বিকেএমইএ) সহ-সভাপতি ও জেলা চেম্বার অব কর্মাস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের পরিচালক ছিলেন।
মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, ২০০২ সালে অপারেশন ক্লিনহার্ট চলাকালীন সময়ে ওই বছরের ২২ অক্টোবর প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে এক সভায় সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেন সাব্বির আলম খন্দকার। ওই বক্তব্যে তিনি নারায়ণগঞ্জের সন্ত্রাসী, গডফাডার ও মাদক ব্যবসায়ীদের নাম প্রকাশ করেছিলেন। সেই সঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেছিলেন। আর ওই বক্তব্য দেয়ার কয়েক মাস পর ২০০৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি দুর্বৃত্তদের গুলিতে তিনি নিহত হন।
সাব্বির আলম হত্যাকাণ্ডের পর তার বড়ভাই অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার বাদী হয়ে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের তৎকালীন বিএনপির এমপি গিয়াসউদ্দিসহ ১৭ জনকে আসামি করে ফতুল্লা থানায় মামলা করেন। এরপর থেকে ৯ জন তদন্তকারী কর্মকর্তা পরিবর্তন হয়। পরে মামলাটি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) স্থানান্তর করা হয়। সিআইডির তৎকালীন এএসপি মসিহউদ্দিন দশম তদন্তকারী কর্মকর্তা দীর্ঘ ৩৪ মাস তদন্ত শেষে ২০০৬ সালের ৮ জানুয়ারি আদালতে আটজনকে আসামি করে চার্জশিট দাখিল করেন।
এতে মামলা থেকে গিয়াসউদ্দিন, তার শ্যালক জুয়েল, শাহীনকে অব্যাহতি দিয়ে সাবেক ছাত্রদল সভাপতি জাকির খান, তার দুই ভাই জিকু খান, মামুন খানসহ আটজনকে আসামি উল্লেখ করা হয়। মামলার প্রধান আসামি গিয়াসউদ্দিনকে মামলা থেকে বাদ দেয়ায় মামলার বাদী তৈমুর আলম খন্দকার সিআইডির দেয়া চার্জশিটের বিরুদ্ধে ওই বছরের ২৪ জানুয়ারি আদালতে ‘না রাজি পিটিশন’ দাখিল করেন।
পিটিশনে তৈমুর আলম বলেছিলেন, গিয়াসউদ্দিনই সাব্বির হত্যাকাণ্ডের মূল নায়ক। গিয়াসউদ্দিন ও তার সহযোগীদের অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিয়ে তদন্তকারী কর্মকর্তা গোঁজামিলের চার্জশিট দাখিল করেছেন। পরে আদালত মামলাটি পুনরায় তদন্তের নির্দেশ দেন।
এরপর থেকে গেলো ৬ বছর ধরে নারায়ণগঞ্জ বিচারিক হাকিম আদালতে (ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট) মামলার শুনানি চলে। কিন্তু ২০০৭ সালের ১৮ এপ্রিল তৈমুর আলম খন্দকার যৌথবাহিনীর অভিযানে গ্রেপ্তার এবং ২০০৮ সালের মে মাসে জামিনে মুক্তি পেলেও বিভিন্ন অজুহাতে নারাজি প্রদানে বিরত ছিলেন তৈমুর।
এর মধ্যে গেলো ১৬ ফেব্রুয়ারি সাব্বির আলম খন্দকার হত্যার মামলার অন্যতম আসামি নারায়ণগঞ্জের আলোচিত শীর্ষ সন্ত্রাসী ও সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামি জাকির খানের বিরুদ্ধে সাক্ষী দেয়ার মাধ্যমে ফের শুরু হয়েছে বিচারকাজ। এদিন বিএনপির চেয়ারপার্সনের সাবেক উপদেষ্টা ও নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার সাক্ষী দিয়েছেন। সাক্ষী শেষে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা আবার অ্যাডভোকেট তৈমূরকে জেরা করেছেন। তবে এদিন জেরা শেষ হয়নি। আদালত আগামী ৬ মার্চ জেরার দিন ধার্য করেছেন।
জাকির খানের পক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট রবিউল হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, সাব্বির আলম খন্দকারের বড় ভাই অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার আদালতে সাক্ষী দিয়েছেন। এটি ২০০৩ সালের একটি হত্যা মামলা। দীর্ঘদিন পর আজ প্রথম মামলার বাদী সাক্ষী দিতে এসেছেন। আমরা জাকির খানের পক্ষে জেরা করেছি। আগামী তারিখেও আবার জেরা করা হবে।
বাবা সাব্বির আলম খন্দকার হত্যার বিচার নিয়ে তার বড় মেয়ে অ্যাডভোকেট খন্দকার ফাতেমা-তুজ-জোহরা সবনম বলেন, ২০০৩ সালে ক্লাস সেভেনে পড়তাম। তখন এতকিছু বুঝতাম না। তবে যতটুকু বুঝতাম আমার এখনও পরিষ্কারভাবে মনে আছে। আমাদের বাসার সামনে বাবাকে গুলি করা হয় সেই আওয়াজটা এখনও আমার কানে বেজে উঠে। ঠিক কয়টা বাজে গুলি করা ও কখন গুলি করা হয়েছে। আজকে ২০ বছর হয়েছে আমার বাবা মারা গেছেন। আর কতদিন আমরা বিচারের আশায় অপেক্ষা করবো। আমার মা এখন বিচারের অপেক্ষা ছেড়ে দিয়েছে। এ বিচার আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিয়েছেন তিনি।
সবনম আরও বলেন, তবে ২০ বছর মামলার প্রথম সাক্ষী হয়েছে। শেষ পর্যন্ত সাক্ষী শুরু হয়েছে এটা ভালো লাগছে। এতদিন পর্যন্ত মামলাটা ঝুলে ছিল। আমরা বিচারের প্রার্থনাই করে যাচ্ছিলাম কিন্তু ২০ বছর যাবত কোনো বিচার হয়নি। যাই হোক সাক্ষী শুরু হয়েছে এটার জন্য আমি খুশি। আমি আশাবাদী আমার বাবার হত্যার উপযুক্ত শাস্তি হবে। আমার বাবা খুবই স্পষ্টভাষী ও সাহসী ছিলেন। নারায়ণগঞ্জের লোকজন তাকে টাইগার বলতো। কারণ আমার বাবার মতো সাহস আর কারো ছিল না।
সাব্বির আলমের বড় ভাই অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার বলেন, আমার ভাই সাব্বির আলম খন্দকার একজন ব্যবসায়ী নেতা হিসেবে সন্ত্রাসী বাহিনী যতো অপকর্ম করেছে এগুলোর বিরোধিতা করেছিল। এ হত্যা মামলায় অন্যতম আসামি জাকির খান হাইকোর্ট থেকে আগাম জামিন নিয়ে ৬ সপ্তাহের মধ্যে হাজির হবে বলে সে দেশত্যাগ করে পালিয়ে যান। এতদিন পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করেনি। প্রকাশ্যে সে চাঁদাবাজি করছে। এ মামলার বাদী এবং সাক্ষীদের প্রকাশ্যে হুমকি দিয়েছে। তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম সে গ্রেপ্তার হওয়ার পর আমরা সাক্ষী দিবো।
তিনি আরও বলেন, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও এ মামলা প্রমাণের জন্য আমরা আদালতে পেশ করবো। আজ সাক্ষী দিয়ে গেলাম, পরে আবার সাক্ষী দিতে আসবো। বিভিন্ন হুমকি ধমকির পরও সাব্বির থামে নাই জাকির খানের চাঁদাবাজি, খুন, মাদক, ঝুট সন্ত্রাস এগুলোর বিরুদ্ধে কথা বলেছিল। আমি সন্ত্রাসীদের সর্বোচ্চ সাজা চাই।
এ বিষয়ে অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর (এপিপি) আব্দুর রহিম গণমাধ্যমকে বলেন, বর্তমান সরকার সন্ত্রাস চাঁদাবাজ জুট সন্ত্রাসী এ ধরনের মামলাগুলোর ব্যাপারে জিরো ট্রলারেন্স। সে প্রেক্ষিতে সাব্বির আলম হত্যাকাণ্ডের বিচারকাজ সম্পন্ন করার রক্ষ্যে সাক্ষীগ্রহণ শুরু হয়েছে। এতদিন বাদী সাক্ষী দিতে না আসার কারণে বিচার কাজ বন্ধ ছিল। যেহেতু সাক্ষী শুরু হয়েছে সাক্ষীর পরিমাণ অনেক বেশি। আশা রাখি দ্রুতই মামলার বিচার কাজ শেষ হবে।