আর্কাইভ থেকে ফিচার

মূত্র জমিয়ে স্বর্ণের খোঁজ !

মূত্র জমিয়ে স্বর্ণের খোঁজ !

ছাপোষা কেরানি পরেশচন্দ্র দত্তর হাতে আচমকাই পাথরটা এসে পড়েছিল। কাচের গুলি ভেবে প্রথমে সেটিকে হেলাফেলা করলেও পরে বুঝতে পারেন, এটি আসলে একটি পরশপাথর। যার ছোঁয়ার যে কোনও ধাতু স্বর্ণে রূপান্তিরিত হয়। রাতারাতি সুদিন ফিরেছিল পরেশের। তবে সে তো পরশুরামের গল্পে!

পরশুরামের গল্পের ভিত্তিতে গড়া সত্যজিৎ রায়ের ‘পরশপাথর’ কাল্পনিক হলেও সাড়ে তিনশো বছরেরও আরও আগে ‘পরশপাথর’-এর খোঁজে নেমেছিলেন বহু অ্যালকেমিস্ট। তাদেরই এক জন জার্মানির হেনিগ ব্র্যান্ড।

হেনিগ এমন এক অজানা উপাদানের খোঁজ শুরু করেছিলেন যার ছোঁয়ায় সীসা বা তামার মতো সাধারণ ধাতুও পরিণত হবে স্বর্ণে । সেই সঙ্গে যে উপাদান কাজ করবে সমস্ত রোগের প্রতিরোধক হিসেবে। অর্থাৎ দীর্ঘজীবন লাভের রাস্তা খুলে গেলো পাকাপোক্তভাবে! পশ্চিমা দেশগুলি একে ‘ফিলোসফার’স স্টোন’-এর তকমা দিয়েছে।

ওই অজানা উপাদানের খোঁজ করেছেন বহু অ্যালকেমিস্ট। হেনিগও ব্যতিক্রম নন। তার ধারণা ছিল যে মানুষের মূত্র থেকে ওই অজানা উপাদান তৈরি করা যায়। যার ছোঁয়ায় স্বর্ণ মেলে। অর্থাৎ মূত্রেই রয়েছে স্বর্ণ।

হেনিগের সম্পর্কে জানা যায়নি বিশেষ কিছু। তবে অনেকের মতে, তার জন্ম ১৬৩০ সালে। তার মৃত্যু নিয়েও রয়েছে ধোঁয়াশা। হতে পারে সেটা ১৬৯২ সাল কিংবা ১৭১০ সাল! জার্মানির হামবুর্গের বাসিন্দা হেনিগ কর্মরত ছিলেন সেনাবাহিনীতে। আবার জুনিয়র অফিসার হিসাবে যুদ্ধেও নাকি গিয়েছিলেন তিনি!

অনেকের দাবি, মধ্যবিত্ত পরিবারের হেনিগের প্রথাগত পড়াশোনা বেশি দূর পর্যন্ত না হলেও আজীবন নানা গবেষণায় মগ্ন ছিলেন হেনিগ। এমনও শোনা যায়, গবেষণার অর্থ জোটাতে মোটা অঙ্কের পণ নিয়ে বিয়ে করেছিলেন তিনি। প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর আবার বিয়ে করেন। এ বার একজন বিত্তশালী বিধবাকে।

গবেষণাই ছিল হেনিগের জীবন। তবে স্বর্ণ পাওয়ার লক্ষ্যে বিপুল পরিমাণ মূত্র কোথায় পাওয়া যায়? অনেকের দাবি, পানশালার মালিকের সঙ্গে রফা করে মূত্র জোগাড় করার কাজে নেমেছিলেন হেনিগ।

স্বর্ণ তৈরিতে কী কী উপাদান প্রয়োজন বলে মনে করেছিলেন জার্মান অ্যালকেমিস্ট? এ ক্ষেত্রে এফ টি কেসলারের লেখা বইয়ের একটি রেসিপি হেনিগের চোখে পড়েছিল বলে দাবি করা হয়। তাতে ফটকিরি, পটাশিয়াম নাইট্রেট এবং মূত্রের মিশ্রণের কথা লেখা রয়েছে। যার মাধ্যমে ধাতুকে রুপোয় পরিণত করা যায় বলে দাবি করা হয়েছিল। যদিও ওই ফর্মূলা কাজ করেনি।

নিজেই গবেষণাগারে স্বর্ণ তৈরির কাজে নেমেছিলেন হেনিগ। গবেষণার জন্য ওই পানশালা থেকে বিয়ারখেকো লোকজনের তাজা মূত্র সংগ্রহ করতে শুরু করেন। এর পর তা বাড়ির বেসমেন্টে জমা করতেন। এক-আধ লিটার নয়, দীর্ঘ দিন ধরে এ ভাবে নাকি দেড় হাজার গ্যালন মূত্র জমা করেছিলেন তিনি।

একবার ভাবুন তো, হেনিগের এই মূত্রাধারের জেরে তার বাড়ির আশপাশে কেমন ‘সুবাস’ ছড়াত! তবে সে যুগে নাকি এমন উদ্ভট শখ অনেকেরই ছিল। সে সময় সার তৈরির কাজে, চামড়া নরম করতে মূত্রের ব্যবহার করা হত। এমনকি, দাঁত পরিষ্কারের জন্য মূত্র ব্যবহার করতেন অনেকে।

তবে হেনিগের লক্ষ্য ছিল অন্য। ১৬৬৯ সাল নাগাদ থেকে মূত্রের থেকে এক উপাদান খুঁজে পেয়েছিলেন তিনি। 

অনেকের দাবি, তাজা মূত্রের সংগ্রহের পর তা বেশ কয়েক দিন রেখে দিতেন তিনি। তা থেকে তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ বের হতে থাকলে সেই মূত্র ফুটানো শুরু করতেন। এক সময় তা ঘন সিরাপের মতো হয়ে এলে ফুটানো বন্ধ করতেন।

ওই ঘন থকথকে মূত্রকে এর পর গরম করতে শুরু করতেন হেনিগ। লালচে তেলের মতো হয়ে এলে তা ছেঁকে বের করে নিতেন। ঠান্ডা হয়ে এলে তার উপরের অংশ কালো রঙের স্পঞ্জের মতো হত। নীচের দিকটা দেখাত অনেকটা জমানো লবনের মতো। এর পর লবনের অংশটি বাদ দিয়ে উপরের কালো অংশের সঙ্গে লাল তেল মিশিয়ে আবারও ফুটানো হত। এ বার ওই মিশ্রণটি টানা ১৬ ঘণ্টা ধরে কড়া আঁচে গরম করতেন তিনি।

এ ভাবেই পুরো প্রক্রিয়ার পর সাদাটে ধোঁয়া বার হতে থাকলে তেল আলাদা হয়ে যেত। এ বার যে উপাদানটি বের হয়ে আসত, সেটি পানির সংস্পর্শে এসে চকচকে একটি কঠিন আকার নিতো। ওই পদার্থ নিয়েই এককালে হামলে পরেছিল পুরো পৃথিবী।

কী সেই পদার্থ? হেনিগ তার নাম দিয়েছিলেন ‘ফসফরাস’। গ্রিক ভাষায় যার অর্থ আলো বহনকারী। ওই চকচকে অংশটি অক্সিজেনের সংস্পর্শে আসামাত্রই জ্বলে উঠত। এমনকি, অন্ধকারেও তা জ্বলজ্বল করত।

স্বর্ণ তৈরিতে ব্যর্থ হলেও পুরো দুনিয়া তাকে চেনে ফসফরাসের আবিষ্কর্তা হিসাবে। বিস্ফোরক তৈরিতে এই অতি শক্তিশালী উপাদান কাজে লাগানো হয়।

এরপরও স্বর্ণ তৈরির চেষ্টা বন্ধ করেননি হেনিগ। আচমকাই ওই আবিষ্কারের পর তা নিয়ে মাতামাতির বদলে গোপন রেখেছিলেন হেনিগ। পরে জার্মানির ড্রেসডেনের এক ব্যক্তিকে তা চড়া মূল্যে বিক্রি করে দেন। তবে বহু যুগ পরে হেনিগের ওই আবিষ্কারই পরিণত হয় অমূল্য রতনে!

অনন্যা চৈতী

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন মূত্র | জমিয়ে | স্বর্ণের | খোঁজ |