আর্কাইভ থেকে বাংলাদেশ

শিশু দুটিকে কেন হত্যা করলেন মা!

শিশু দুটিকে কেন হত্যা করলেন মা!

নাপা সিরাপ নয়, মায়ের দেয়া বিষ মেশানো মিষ্টি খেয়েই মৃত্যু হয় ব্রাক্ষণবাড়িয়ার দুই শিশুর। দেশব্যাপী তোলপাড় হওয়া এ খবরের ঘটনায় গ্রেপ্তার করা হয় মা রিমা বেগমকে। বিস্ময় সৃষ্টির পাশাপাশি গত কয়েকদিনে সামাজিকমাধ্যমে তাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে ফেলেছেন অনেকেই। 

কিন্তু কিছু প্রশ্ন যেন সবার মনকেই বিদ্ধ করে আসছিলো বারবার, কেনো একজন মা এত নিষ্ঠুর হলেন, নিজের সন্তানদের হত্যা করলেন,শুধু কি পরকীয়া নাকি অন্য কোনো কারণও ছিলো এ হত্যার পিছনে। এমন অনেক প্রশ্নেরই কিছু উত্তর যেন মিলেছে পুলিশের কাছে দেয়া রিমা বেগমের জবানবন্ধীতে। 

গণমাধ্যম থেকে নেয়া রিমার দেয়া জবানবন্দী হুবুহু তুলে দেয়া হলো-

‘চালকলের সর্দার সোফাই আমার কাছে জানতে চায়- তার বিয়ের প্রস্তাবে আমি রাজি কিনা। দুই পুত্র নিয়ে পুনরায় বিয়ের বিষয়ে অস্বস্তির কথা বলি তাকে। তখন সে বলে, পথের কাঁটা কীভাবে দূর করতে হয় জানি। এর আগে রাইস মিলের মহিলাকর্মী আনু মালার মাধ্যমেও আমাকে প্রস্তাব দেয় সোফাই। তখনও বলেছি, সোফাই এবং আমার দু'জনের সংসার আছে। আমার পক্ষে সন্তানসহ বিয়ে করা সম্ভব নয়। আমার সন্তান না থাকলে রাজি হতাম। এরপর আরও দু'বার প্রস্তাব এলে না করেছি। যে ফোন ব্যবহার করে সোফাই সর্দারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলাম ঘটনার পরপরই সেটি চালকলের কর্মী আনু মালার মাধ্যমে তার কাছে ফেরত পাঠিয়ে দেই।’

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দুই শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় তাদের মা রিমা বেগম ওরফে লিমার আদালতে দেয়া জবানবন্দি এবং পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে এ ঘটনার মূল রহস্য জানা যায়। 

চরম অর্থকষ্ট, ঋণের চাপ, স্বামীর অক্ষমতা ও ভালো জীবনের নিশ্চয়তার প্রলোভনের তীব্র চাপে ছিলেন রিমা। রিমাকে বিয়ে করার প্রলোভন দেখিয়ে তার দুই সন্তান ইয়াছিন ও মোরসালিনকে হত্যা করার ছক করে চালকলের সর্দার সোফাই। সমাজের পিছিয়ে পড়া জীবনসংগ্রামী নারীকে ফাঁদে ফেলার টোপটা ভালোভাবেই দিতে পেরেছিলো সর্দার সোফাই। অসুস্থ বাচ্চাদের নিয়ে রিমা যখন হাসপাতালে তখনও সোফাই সর্দার গিয়ে তাদের দেখভালের নাটকটাও ভালোমতো সেরেছে।

দুই শিশুর বাবা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ইসমাইল হোসেন সুজন গণমাধ্যমকে বলেন, সিলেটে ইটভাটায় ছোটখাটো কাজ করতেন তিনি। ছেলের মৃত্যুর সংবাদ শুনে গ্রামে আসেন ইসমাইল। এক দিন যাওয়ার পরই হঠাৎ রিমা জানায়, তার মোবাইল হারিয়ে গেছে। এরপরই তার সন্দেহ হয়। মোবাইল কোথায় আর ছেলেদের আসলে কী হয়েছে এটা না জানালে আত্মহত্যা করবেন এ কথা জানানোর পর এক দিন পরই রিমা জানায়, মোবাইল সোফাই সর্দারের কাছে রয়েছে। তখন স্থানীয় চেয়ারম্যানকে ঘটনা জানানো হলে তারা প্রশাসনের লোক এনে রিমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে আসল ঘটনা বের হয়ে আসে।

রিমা পুলিশের কাছে স্বীকারোক্তিতে জানিয়েছেন, এক যুগ আগে অজান্তেই পারিবারিকভাবে আশুগঞ্জের ইসমাইল হোসেনের সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয় তার। রিমার মা এ বিয়ে ঠিক করেছিলেন। বিয়ের পর জানতে পারেন তার স্বামী একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। তেমন কোনো কাজকর্মও করতে পারেন না ইসমাইল। বিয়ের ১৫ দিন পর রিমা বাবার বাড়িতে গেলে মাকে জানিয়ে দেন, ওই সংসার চালানো তার পক্ষে সম্ভব নয়। তখন রিমার মা বলেন, ইসমাইলের সঙ্গেই সংসার করতে কারণ তারা গরীব।

পরবর্তী সময়ে ইসমাইল তার চাচাত ভাইকে নিয়ে গিয়ে রিমাকে অনুরোধ করে বাসায় নিয়ে আসেন। এরপর ইসমাইলের মা-বাবা, ভাই-বোন রিমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতে থাকেন। রিমা ও ইসমাইলকে আলাদা করে দেন। ইসমাইল তার বাবার কাছ থেকে পাওয়া আধা শতাংশ জমি বিক্রি করে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা পান। বিয়ের এক বছরের মাথায় রাইস মিলে কাজ নেন রিমা। কাজ করে স্বামীর জমি উদ্ধার করেন। তবে অনেক ঋণের বোঝায় চাপা পড়েন। বিয়ের দুই বছরের মাথায় বড় ছেলের জন্ম হয়। তার নাম রাখা হয় রহিম। জন্মের দুই দিনের মাথায় সে মারা যায়। অসুস্থ শরীর নিয়ে আবার কাজে যোগ দেন রিমা। স্বামীর বিক্রি করা আধা শতক জমি আবার ফিরিয়ে আনা হয়। এরপর দ্বিতীয় সন্তান ইয়াছিনের জন্ম হয়। এরপর দেড় বছরের মাথায় তৃতীয় পুত্র মোরসালিনের জন্ম। রিমার জবানবন্দিতে জানান, অসুস্থ শরীর নিয়েই টানা সাত বছর কাজ করেছেন তিনি।

নিহত দুই সন্তানের মা আরও জানান, দীর্ঘ সময় তিনি একাই সংসার চালিয়ে নিয়েছেন। স্বামীকে ঘরে প্রস্রাব-পায়খানা করাতে সহায়তা করতেন রিমা। এরপর আগের কর্মস্থল ছেড়ে এক সময় এস আলম রাইস মিলে কাজ শুরু করেন তিনি। সংসার চালাতে অনেক ঋণ করে ফেলেন। মাসে ১০ হাজার টাকা কিস্তি। সঞ্চয় দিতে হতো এক হাজার টাকা। 

এস আলম মিলে গিয়েই সোফাই সর্দারের সঙ্গে পরিচয় হয় রিমার। দুই মাস পার হওয়ার পরই সোফাই তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। দু'বার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়ার পর সোফাই তাকে সুন্দর জীবনের লোভ দেখান। স্বামীর অক্ষমতা এবং কষ্টকর জীবন থেকে মুক্তির জন্য সোফাইয়ের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ান তিনি। একটানা সাত দিন বিশ্বরোডে আবাসিক হোটেলের তৃতীয় তলায় সোফাই ও রিমা একসঙ্গে ছিলেন। 

রিমা জানান, দু'জনের মধ্যে ফোনে কথা হতো। ভালোবেসে সে একটি শ্যাম্পু, একটি লোশন, এক জোড়া জুতা, দুটি কাঁকড়া ব্যান্ড ও ক্রিম উপহার দিয়েছে। হোটেলে যেতে কখনও রাজি না হলে সোফাই ভীষণ মারতো রিমাকে। 

রিমা আরও জানান, চলতি মাসের ৭ তারিখ সোফাই তাকে ফোন করে পুনরায় বিয়ের প্রস্তাব দেন। শাশুড়ি বাড়ি নেই জেনে রিমাকে মিষ্টির পলিথিন দিয়ে যান সোফাই। এও বলেন, দুই সন্তানকে বিষ মাখানো মিষ্টি খাওয়ানোর পর পথের কাঁটা শেষ হয়ে যাবে। রিমাকে ৫টি মিষ্টি দেন সোফাই। এরপর আবারও ফোন করে রিমার শাশুড়িকে তার কাছে পাঠাতে বলেন। শাশুড়ি যাওয়ার পর রিমার বিলের ২ হাজার টাকা তার হাতে দেন। টাকা নিয়ে ফেরার পর দুই ছেলের জন্য নাপা সিরাপ আনতে শাশুড়িকে ফার্মেসিতে পাঠান রিমা। এরপরই খালি বাসায় দুই ছেলেকে সোফাই সর্দারের নির্দেশ মতো বিষ মেশানো মিষ্টি খাওয়ানো হয়। এরই মধ্যে শাশুড়ি ফিরলে তাদের নাপা সিরাপ খাওয়ানো হয়। সোফাই সর্দার তাকে শিখিয়ে দেন বিষ মাখানো মিষ্টি খাওয়ানোর পর দুই ছেলের মৃত্যুর কারণ হিসেবে জ্বরের ওষুধের কথা বলতে। নাপা খাওয়ানোর ১০-১৫ মিনিটের মধ্যে বমি শুরু করে দুই সন্তান। ওদের মাথায় পানি ঢালা শুরু করেন। এরপর সন্তানদের এলাকার 'মইনুল ডাক্তারের' দোকানে নিয়ে যান। মইনুলের পরামর্শে আশুগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রিমা তার দুই সন্তানকে ভর্তি করেন। আসল ঘটনা গোপন করে চিকিৎসককে জানানো হয়, নাপা খাওয়ার পর থেকে দুই শিশু অসুস্থ। জরুরি বিভাগ থেকে বলা হয়, 'টকমিশ্রিত পানি খাওয়ালে' ঠিক হয়ে যাবে। এরপর হাসপাতাল থেকে দুই সন্তানকে বাসার দিকে নিয়ে যান রিমা ও তার শাশুড়ি। ছোট ছেলে পথে পানি চাইলে শাশুড়ি তা দেন। পানি খেয়েই সিএনজি অটোরিকশার মধ্যে নিথর হয়ে যায় ছোট ছেলে। বাড়িতে ফিরে বিছানায় শোয়ানোর পর সে নিস্তেজ হয়ে যায়।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুলিশ সুপার আনিসুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, হত্যার ঘটনার দিন সোফাই সর্দারের সঙ্গে ১৫ বার ফোনে কথা বলেন রিমা। ফোন কলের সূত্র ধরেই পুলিশ তদন্ত শুরু করলে হত্যা পরিকল্পনার কথা বেরিয়ে আসে।

পুলিশের অপর এক কর্মকর্তা জানান, দুই শিশুর ভিসেরা প্রতিবেদন পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন তারা। যে ফার্মেসি থেকে নাপা সিরাপ কেনা হয়েছে সেখান থেকে আটটি নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করে ক্ষতিকর কোনো উপাদান পায়নি ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর।

ইসমাইল হোসেনের দায়ের করা মামলায় সোফাইকে আসামি করা হলেও পুলিশ তাকে এখনও গ্রেপ্তার করতে পারেনি।

অনন্যা চৈতী

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন শিশু | দুটিকে | কেন | হত্যা | মা