ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজায় স্থল, আকাশ ও সাগর থেকে নির্বিচারে হামলা করছে ইসরায়েল। আবাসিক এলাকা ও শরণার্থী শিবিরে গুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে শত শত ভবন। অকাতরে প্রাণ যাচ্ছে ফিলিস্তিনিদের। এর মধ্যে বেশিভাগই নারী ও শিশু। এতদিন হামলা চালালেও গাজায় ইসরায়েল শুধু হামাস নির্মুলের কথা বলে এসেছে। তবে এবার ইসরায়েলি শীর্ষ নেতারা সরাসরি বলছেন যে, গাজার নিয়ন্ত্রণ নিতে চান তারা। তবে ইসরায়েলের এমন সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত নয় বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর একজন সিনিয়র উপদেষ্টা মার্ক রেগেভ বলেন, ইসরায়েল গাজার নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সেখানে সেনা নিয়োগের পরিকল্পনা করছে। যদিও তিনি দাবি করেছেন যে, রাজনৈতিকভাবে তারা গাজা শাসন করতে চান না।
গাজায় ইসরায়েলি সেনার উপস্থিতি এবং তাদের অনুগত কাউকে ক্ষমতায় বসানোর আর দখল করার মধ্যে পার্থক্য দেখছেন না বিশ্লেষকরা। নেতানিয়াহুর উপদেষ্টা মার্ক রেগেভ সোমবার সিএনএনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, 'যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর, যখন হামাসের অস্তিত্ব থাকবে না তখন সেখানে নিরাপত্তা বজায় রাখা জরুরি। যাতে এমন আরেকটি গোষ্ঠী পুনরুত্থিত না হতে পারে।'
সোমবার একই বিষয়ে মন্তব্য করেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। তিনি বলেন, 'গাজায় হামাসকে নির্মুলের পর অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব পালন করবে ইসরায়েল।'
নেতানিয়াহুর উপদেষ্টা বলেন, 'গাজায় ইসরায়েলি নিরাপত্তার উপস্থিতি থাকতে হবে, কিন্তু এর মানে এই নয় যে ইসরায়েল গাজা পুনঃদখল করছে। এর মানে এই নয় যে গাজাকে শাসন করার জন্য ইসরায়েল সেখানে আছে।'
বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেছেন যে গাজার সীমানা এবং আকাশসীমার উপর ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণ, এমনকি বর্তমান সংঘাতের আগে, মানে ২০০৫ সালে ইসরায়েলি অবৈধ বসতিগুলো অপসারণের পরও ইসরায়েল গাজা দখল অব্যাহত রেখেছে।
রেগেভ দাবি করেন, ইসরায়েল চায় গাজায় ফিলিস্তিনিরা নিজেদের শাসন করুক। যদিও ইসরায়েলি বেশ কয়েকটি সংস্থা এরই মধ্যে গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের ব্যাপকভাগে বিতাড়নের আহ্বান জানিয়েছে।
নেতানিয়াহুর মন্তব্যের পর মঙ্গলবার হোয়াইট হাউজ জানায়, ইসরায়েলের গাজার নিয়ন্ত্রণ নেয়া উচিত হবে না। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর তারা গাজার সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্ব অনির্দিষ্টকালের জন্য নেয়ার যে কথা বলছে সেটি উচিত বলে বিশ্বাস করে না যুক্তরাষ্ট্র।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের মুখপাত্র জন কিরবি সিএনএনকে বলেন, 'প্রেসিডেন্ট বাইডেন এখনও বিশ্বাস করেন যে ইসরায়েলি বাহিনীর দ্বারা গাজা পুনরুদ্ধার করা উচিত নয়। এটা ইসরায়েলের জন্য ভালো হবে না, ইসরায়েলের জনগণের জন্যও ভালো নয়।'
তিনি বলেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন এই অঞ্চল সফর করে যে কথোপকথন করেছেন তার মধ্যে একটি হলো- সংঘর্ষ পরবর্তী গাজা দেখতে কেমন হবে। গাজায় শাসন ব্যবস্থা কেমন হবে? যদিও যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের মতই হামাসকে গাজার নিয়ন্ত্রণ থেকে সরাতে চায়।
সোমবার এবিসি নিউজকে দেয়া সাক্ষাৎকারে নেতানিয়াহু বলেন, 'আমি মনে করি ইসরায়েল অনির্দিষ্টকালের জন্য গাজার নিরাপত্তার দায়িত্ব নেবে। কারণ আমরা দেখেছি সেখানে আমরা নিরাপত্তার দায়িত্বে না থাকলে কী হয়।' এরপরই এ বিষয়ে সতর্ক করলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
গাজায় নির্বিচারে হামলা চালানোর পর এটিই ছিল ইসরায়েলের প্রথম ইঙ্গিত। কারণ এর আগে বারবার ইসরায়েল বলে আসছিল যে, তারা গাজার দখল নিতে চাই না।
এর আগে গাজায় স্থল অভিযান নিয়েও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছিল। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন গত মাসে সিবিএসের '৬০ মিনিটস' এ এক সাক্ষাৎকারে বাইডেন বলেন যে, গাজায় স্থল অভিযান এবং এর দখল নেয়া ইসরায়েলের জন্য একটি বড় ভুল হবে।
সে সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূত মাইকেল হারজোগ বলেন, ইসরায়েল সংঘাত শেষ হওয়ার পরে গাজা দখল করতে চায় না।
গেলো ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের নিরাপত্তাবাহিনী লক্ষ্য করে হামলা চালায় গাজার শাসকগোষ্ঠী হামাস। ইসরায়েল দাবি করে হামাসের হামলায় ১৪০০ এর বেশি ইসরায়েলি নিহত হয়েছে। তাদের মধ্যে চার শতাধিক নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্য। তবে হামাসের শীর্ষ নেতারা বারবার বলেছেন, তারা কোনো বেসামরিক মানুষকে লক্ষ্য করেনি এবং হত্যা করেনি। সংঘাতের শুরুর দিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট দাবি করেছিলেন যে, হামাস নির্মমভাবে ইসরায়েলে ৪০ শিশুকে হত্যা করেছে। যদিও পরে এর পক্ষে কোনো প্রমাণ দিতে না পারায় তার বক্তব্যের জন্য দু:খ প্রকাশ করে হোয়াইট হাউজ।
হামাসের হামলার জবাবে অবরুদ্ধ গাজায় নির্বিচারে হামলা শুরু করে ইসরায়েল। এছাড়া গাজায় সর্বাত্মক অবরোধ আরোপ করে নেতানিয়াহু প্রশাসন। এর ফলে গাজার প্রায় ২৩ লাখ মানুষের জীবন অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। জ্বালানি, খাদ্য, ওষুধসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের তীব্র সংকটে পড়েছে গাজাবাসী।
আবাসিক এলাকা, শরণার্থী শিবির, হাসপাতাল, মসজিদ, গির্জা, জাতিসংঘ পরিচালিত স্কুল, খাদ্যের গুদাম, ব্যাকারি, অ্যাম্বুলেন্স, পানির টাংকি, জ্বালানি স্থাপনাসহ প্রায় সকল স্থানে বোমা ফেলেছে ইসরায়েল। ইসরায়েলের হামলা ও জ্বালানি সংকটে বন্ধ হয়ে গেছে বেশিরভাগ হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র।
৭ অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরায়েলের নির্বিচারে হামলায় ১০ হাজার ৩২৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে যে, গাজায় নিহত ১০,৩২৮ জনের মধ্যে ৪,২৩৭টি শিশু এবং ২,৭১৯ জন নারী। আহত মানুষের সংখ্যা প্রায় ৩০ হাজার। শত শত ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে আশ্রয়কেন্দ্র বা খোলা আকাশের নিচে রাত কাটাচ্ছেন।
কাতার, ইসরায়েল ও মিশরের মধ্যস্ততায় ২১ অক্টোবর থেকে সামান্য পরিমাণে সাহায্য রাফাহ সীমান্ত দিয়ে গাজায় প্রবেশ করছে। তবে জাতিসংঘ জানিয়েছে যে, গাজায় যে নির্মম মানবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে সেখানে আরও সাহায্য এবং জ্বালানি প্রয়োজন। তা না হলে লাখ লাখ মানুষের জীবনহানির শঙ্কা রয়েছে।
সূত্র: সিএনএন, আল জাজিরা