১৯৯৩ সালের ২৩ এপ্রিল ভোর সাড়ে ৩টা। ফ্রান্সের এক গোপন জায়গা। সেই জায়গায় বুটের মধ্যে লুকিয়ে রাখা একটা কিছু পুঁতে দেয়ার জন্য প্রাণপণে মাটি খুঁড়ে চলেছেন এক ব্যক্তি। মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে হাত থেকে রক্ত বেরিয়ে গেলেও সেই দিকে হুশ নেই তার। কাজ শেষে গাড়ি চালিয়ে একটি ক্যাফেতে যান ওই ব্যক্তি। সারা গায়ে মাটি। সেই অবস্থাতেই কফির কাপে চুমুক দেন। এ ব্যক্তিকে গোটা ফ্রান্স চেনে ম্যাক্স ভ্যালেনটিন নামে। যে জিনিসটি মাটির নীচে তিনি পুঁতেছিলেন, তা ব্রোঞ্জ দিয়ে তৈরি পেঁচার একটি ছোট মূর্তি।
কিন্তু কেন এত গোপনে পোঁতা হয়েছিল এ ছোট মূর্তিটি?
ম্যাক্স ঘোষণা করেছিলেন, যে এ মূর্তিটি খুঁজে পাবেন তাকে একই মাপের সোনা, রুপো, রুবি এবং হিরেখচিত একটি পেঁচার মূর্তি উপহার দেয়া হবে। যার বর্তমান মূল্য প্রায় সওয়া এক কোটি টাকা।
ম্যাক্সের আসল নাম রেগিস হাউসার। এক সময়ের বিপণন পরামর্শদাতা ম্যাক্স, শিল্পী মিশেল বেকারের সহযোগিতায় এক পেঁচার মূর্তি তৈরি করেছিলেন। ধাঁধাগুলির নকশা তৈরিতেও মিশেল সাহায্য করেছিলেন ম্যাক্সকে।
ম্যাক্সের এ ঘোষণার পর রাতারাতি ওই মূর্তি খুঁজতে শুরু করেন হাজারো মানুষ।
তবে ওই গুপ্তধনের হদিস পাওয়া অত সহজ ছিল না। ১১টি ধাঁধার সমাধান করলে তবেই খুঁজে পাওয়া যাবে এ গুপ্তধন। একাধিক ভাষা, গাণিতিক, ঐতিহাসিক এবং মানচিত্রিক ধাঁধা মিলিয়ে ১১টি ধাঁধা তৈরি করেন ম্যাক্স।
২০০৯ সালে মারা যান ম্যাক্স। এখনও পর্যন্ত এ পেঁচার মূর্তির খোঁজ পাননি কেউ। কিন্তু এ মূর্তি খোঁজাটা এখন অনেক মানুষের কাছেই নেশার মতো হয়ে গিয়েছে।
ফ্রান্সে এমন কিছু মানুষ রয়েছেন যারা এখনও এ মূর্তিটির খোঁজ চালিয়ে যাচ্ছেন। এমনকি, বেশ কিছু মানুষ এ মূর্তি অনুসন্ধানকারীদের নিয়ে একটি দলও তৈরি করেছেন। তারা সারা বছরের যাবতীয় খোঁজ নিয়ে কথা বলতে একটি বার্ষিক বৈঠকও করেন।
ব্রিটিশ চিত্রগ্রাহক এমিলি গ্রাহাম মূর্তি খুঁজে পেতে উৎসাহী বেশ কিছু মানুষের সঙ্গে তাদের অভিযানে সঙ্গ দেন। গণমাধ্যমকে তিনি জানান, এ মূর্তি খুঁজে পেতে কিছু মানুষ যে পরিমাণ আগ্রহ উদ্দীপনা দেখিয়েছেন তিনি তা অন্য কোনও ব্যাপারে কোনও দিনই দেখেননি।
অনেকে তো আবার এ মূর্তির খোঁজে চাকরি-বাড়ি ছেড়ে ১১টি ধাঁধা সমাধানেই লেগে গিয়েছেন। তেমনই একজন ৭৮ বছর বয়সি অবসরপ্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়ার যুভান ক্রোলেট। যিনি শেষ ২০ বছর ধরে এ ধাঁধাগুলি সমাধানে মগ্ন।
ক্রোলেটের দাবি, তিনি এ ধাঁধাগুলি সমাধান করে নির্দিষ্ট ওই জায়গাটি খুঁজে পেয়েছেন। এ জায়গাটি ড্রোমের লুস-লা-ক্রোইক্স-হাউটের একটি পাহাড়ের ধারে বলে দাবি তার। কিন্তু সেখানে অনেক খোঁজাখুজি করেও খালি হাতে ফিরতে হয়েছিল ক্রোলেটকে।
এর পরই ক্রোলেট দাবি করেন, পেঁচা খোঁজার পুরো বিষয়টিই ভাঁওতা। ২০১৮ সালে তিনি ম্যাক্সের পরিবারের বিরুদ্ধে আইনি অভিযোগ দায়ের করে পেঁচা-রহস্যের সমাধান প্রকাশ্যে আনার কথা বলেন। সেই মামলা চলছে এখনও।
ক্রোলেটের মতো আরও বহু মানুষ রয়েছেন, যারা মনে করেন আসলে কখনও কোনও মূর্তি পুঁতেই রাখেননি ম্যাক্স।
অনেকে আবার এ-ও দাবি করেন, ম্যাক্স এক জন বিকৃত মানসিকতার মানুষ ছিলেন। অনেক মানুষকে বিপদে ফেলার জন্য তিনি এ ফাঁদ পেতেছিলেন বলেও অনেকের দাবি।
তবে ২০১৪ সালে এক বার এ মূর্তি নিলামে তুলে বিক্রি করে দেওয়ার চেষ্টা করেন ফ্রাঙ্ক বেকার। এ-ও ঘোষণা করেন, তার মৃত্যুর পর এ মূর্তি খুঁজে পাওয়ার চুক্তি বাতিল হয়ে যাবে। তবুও এখনও মূর্তির খোঁজে প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছেন বেশ কিছু উৎসাহী মানুষ।
অনন্যা চৈতী
