ভারত বিভক্তির পর পূর্বপাকিস্তান সরকারের অত্যাচার ও নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল বাঙালিরা।তাদের মনে ধীরে ধীরে দানা বাঁধতে থাকে স্বাধীনতার স্বপ্ন।ভাষা আন্দোলনেই তার বীজ নিহিত ছিল।পরবর্তীতে চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ছেষট্টির ৬দফা ঘোষণা, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচনের পর আওয়ামীলীগকে ক্ষমতায় যেতে না দেয়াসহ নানা কারণে বাঙালিরা ফুঁসে ওঠে।বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭মার্চ ভাষণের পর বাঙালি প্রস্তুত হয় স্বাধীনতার জন্য। এই আশায় বাঙালি নেমেছিল রাজপথে। আর পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তা বাঙালিকে দিয়েছিল ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের ভয়াল কালরাত। বাঙালির শরীরে রাইফেল ও বেয়োনেটের নৃশংসতায় কেঁপে উঠেছিল পুরো ঢাকা। আজ সেই ভয়াল কালরাত ও গণহত্যা দিবস।
১৯৭১ সালের এই দিনের শেষে রাতের অন্ধকারে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী হিংস্র হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল নিরীহ-নিরস্ত্র বাঙালি জনগণের ওপর। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী পূর্ণ সামরিক সম্ভার নিয়ে রাত ১০টার পর সারা দেশে পৃথিবীর ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসলীলা শুরু করে তারা। সামরিক ভাষায় অপারেশন সার্চলাইট’ নামে পরিচিত ছিল পাক-হানাদারদের এ হত্যা-অভিযান।
এর আগে, পূর্ব পাকিস্তান সফর শেষে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের এই দিন সন্ধ্যা পৌনে ৬টায় প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে সরাসরি এয়ারপোর্ট চলে যান। নিরপরাধ বাঙালির ওপর সশস্ত্র হামলা চালানোর নির্দেশ দিয়ে তিনি রাত পৌনে ৮টায় গোপনে বিমানে ঢাকা ত্যাগ করেন। পাক হানাদার বাহিনীর জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে জল্লাদের মতো বাংলার নিরপরাধ জনগণের ওপর মেশিনগান, মর্টার আর ট্যাংক নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং শহরে ৫০ হাজারেরও বেশি মানুষকে হত্যা করে।
রাত ১টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে পরিকল্পনা অনুযায়ী ২২তম বেলুচ রেজিমেন্টের সেনারা পিলখানা ইপিআর হেডকোয়ার্টারে আক্রমণ চালায়। পাশাপাশি রাজারবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শাঁখারিবাজারসহ ঢাকাজুড়েই শুরু হয় হামলা। বিভিন্ন এলাকায় হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগ করে বর্বর পাক হানাদার বাহিনী। মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকে ট্যাংক, সঙ্গে সেনা বোঝাই লরি। ইকবাল হল (বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল), জগন্নাথ হলে মধ্যযুগীয় কায়দায় চলে পাকিস্তানি হানাদারদের বর্বরতা। শহিদ হন কয়েকশ ছাত্রছাত্রী। ড. গোবিন্দচন্দ্র দেব, ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, ড. মনিরুজ্জামানসহ নয়জন শিক্ষককে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়।
বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করতে ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে যা্যয় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দল। তার অঅগেই ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। গোপন ওয়্যারলেস বার্তায় তিনি বলেন, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আমাদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছে। ছাত্র-জনতা-পুলিশ-ইপিআর শত্র“র বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রাম শুরু হয়েছে। আমি ঘোষণা করছিÑআজ থেকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। সর্বস্তরের নাগরিকদের আমি আহ্বান জানাচ্ছিÑআপনারা যে যেখানে যে অবস্থাতেই থাকুন, যার যা আছে তাই নিয়ে দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ না করা পর্যন্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলুন। সম্মিলিতভাবে শত্র“র মোকাবিলা করুন। এই হয়তো আপনাদের প্রতি আমার শেষ বাণী হতে পারে। আপনারা শেষ শত্র“টি দেশ থেকে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যান।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতের ঢাকার পরিস্থিতি ও বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের ঘটনা ২৭মার্চেই বিশ্বের অন্তত ২৫টি দেশের পত্রিকা ও সংবাদ সংস্থার খবরে প্রকাশ হয়।
ভয়েস অব আমেরিকার খবরে বলা হয়, ‘ঢাকায় পাকিস্তান বাহিনী আক্রমণ শুরু করেছে।শেখ মুজিবুর রহমান একটি বার্তা পাঠিয়েছেন। সারাবিশ্বের কাছে সহযোগিতার আবেদন জানিয়েছেন তিনি।’
নিউইয়র্ক টাইমস-এও শেখ মুজিবুর রহমান ও ইয়াহিয়ার ছবি ছাপানো হয়।পাশেই লেখা হয়‘স্বাধীনতা ঘোষণার পরই শেখ মুজিব আটক।’
দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ, লন্ডন ২৭মার্চের পত্রিকায়‘ সিভিল ওয়ার ফ্লেয়ারস ইন ইস্ট পাকিস্তান: শেখ এ ট্রেইটর, সেইস প্রেসিডেন্ট' শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদে শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক পূর্বপাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা ও ইয়াহিয়া খানের ভাষণে শেখ মুজিবকে ‘বিশ্বাসঘাতক ’বলার কথা উল্লেখ করা হয়।
ব্রিটেনের বহুল প্রচারিত এভিনিং টাইমসের শিরোনাম ছিলো-শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রেফতার নিয়ে ধোয়াশা সৃস্টি।এতে বলা হয়, গতকাল রাতে পূর্ব পাকিস্তানে ট্যাংক ও আর্টিলারি বাহিনীর হামলায় শেখ মুজিবুর রহমানের অন্তত ১০হাজার সমর্থক নিহত হয়েছেন।শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন।
পাকিস্তানের বহুল প্রচারিত ডন পত্রিকার প্রথম পাতার প্রধান শিরোনাম ছিলো-পূর্ব পাকিস্তান পুরোপুরি সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে, শেখ মুজিবুরকে বাসা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। একই পাতায় সিঙ্গেল কলামে আরেকটি সংবাদের শিরোনাম ছিলো-মুজিব ঠিক ৬৬সাল থেকেই বিচ্ছিন্ন হতে চেয়েছিলো।
বর্বর হত্যাযজ্ঞের দিনটি গণহত্যা দিবস’ হিসাবে বাংলাদেশে পালিত হচ্ছে। ‘গণহত্যা দিবস’ উপলক্ষ্যে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাণী দিয়েছেন। স্বাধীনতার জন্য প্রাণ উৎসর্গকারীদের প্রতি তারা গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন।
কর্মসূচি : যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি পালনের লক্ষ্যে জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এ উপলক্ষ্যে সোমবার রাত ১১টা থেকে ১১টা ৩১ মিনিট পর্যন্ত সারা দেশে প্রতীকী ‘ব্ল্যাক আউট’ পালন করা হবে। তবে কেপিআই এবং জরুরি স্থাপনা এ কর্মসূচির আওতামুক্ত থাকবে। এদিন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে গণহত্যা দিবসের ওপর আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে।
সারা দেশে গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গীতিনাট্য ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করা হবে। স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসাসহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিশিষ্ট ব্যক্তি এবং বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কণ্ঠে ২৫ মার্চ গণহত্যার স্মৃতিচারণা ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। ঢাকাসহ সব সিটি করপোরেশনে গণহত্যার ওপর দুর্লভ আলোকচিত্র ও প্রামাণ্যচিত্র প্রচার করা হবে।
আওয়ামী লীগের কর্মসূচি : গণহত্যা দিবস উপলক্ষ্যে সোমবার বিকালে ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় প্রাঙ্গণে ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণ আওয়ামী লীগের যৌথ উদ্যোগে সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে। এতে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত থাকবেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।