জাতীয়

আল জাজিরার তথ্যচিত্রে ড. ইউনূসের নেতৃত্বের প্রশংসা

বায়ান্ন প্রতিবেদন

ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পালাবদল ও গণতান্ত্রিক উত্তরণ নিয়ে একটি বিশেষ তথ্যচিত্র প্রকাশ করেছে কাতারভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা। এতে শেখ হাসিনার শাসনামলের ভয়াবহ দুঃশাসন, দমন-পীড়ন ও রাজনৈতিক অস্থিরতার চিত্র যেমন ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, তেমনই শেখ হাসিনার পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে বাংলাদেশের পুনর্গঠন ও গণতান্ত্রিক পুনরুদ্ধারের ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে। বিশেষ করে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দক্ষ নেতৃত্ব এবং সংকটকালে সঠিক দিকনির্দেশনার কথা আল জাজিরার তথ্যচিত্রে গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে।

শুক্রবার (০২ মে) প্রকাশিত আল জাজিরার ‘রিবিল্ডিং বাংলাদেশ ডেমোক্রেসি আফটার শেখ হাসিনা’ শীর্ষক তথ্যচিত্রে তুলে ধরা হয়েছে, কীভাবে গত ১৫ বছরে পুলিশ, র্যাবসহ বিভিন্ন নিরাপত্তা বাহিনীকে ব্যবহার করে খুন, গুম ও নির্যাতনের মাধ্যমে বিরোধী মত ও ভিন্ন চিন্তাধারাকে দমন করা হয়েছে। পাশাপাশি এতে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে গড়ে ওঠা ফ্যাসিবাদের রূপরেখাও বিশদভাবে তুলে ধরা হয়েছে।

এতে আরও বলা হয়, আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের আমন্ত্রণ জানান।

প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার জন্য শিক্ষার্থীরা যোগাযোগ করে জানিয়ে ড. ইউনূস বলেন, ‘তারা (শিক্ষার্থীরা) আমাকে ফোন দিয়েছিল, আমি বললাম, না আমি না। আমি দেশ পরিচালনার সঙ্গে জড়িত হতে চাই না। বাংলাদেশে অনেক যোগ্য লোক আছে, তাদের খুঁজে বের করো। কিন্তু সবাই বলছিল, আপনাকেই সেখানে থাকতে হবে।’

তথ্যচিত্রে বলা হয়, ২০২৪ সালে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের জেন জির বেশিরভাগের কাছে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে থাকলেও অনেক অভিভাবকের কাছে তিনি ছিলেন ট্রাজিক নায়িকা। তার বাবা শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি। তিনি ১৯৭১ সালে ক্ষমতায় আসেন এবং পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। কিন্তু এর চার বছর পর শেখ হাসিনার ইউরোপ সফরের সময় তার বাবাকে সপরিবারে সামরিক অভ্যুত্থানে হত্যা করা হয়।

পরে বিদেশে নির্বাসন জীবন কাটিয়ে ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে রাজনীতিতে সক্রিয় হন শেখ হাসিনা।  ১৯৯৬ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রথম মেয়াদে নির্বাচিত হন। ২০০৮ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হন তিনি। এরপর ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে টানা তিনটি বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা। এই সময়ে বিরোধীদলের অনেক নেতাকর্মীকে হাসিনার নিরাপত্তা বাহিনী বিনাবিচারে আটকে রাখে।

ভুক্তভোগী পরিবারের একজন হুম্মাম কাদের চৌধুরী। ২০১৫ সালে তার বাবা বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে ফাঁসি দেয়া হয়। ফাঁসি কার্যকরের ৯ মাস পর হুম্মামকে হাসিনার নিরাপত্তা বাহিনী অপহরণ করে একটি জানালাবিহীন কক্ষে আটকে রাখে।

 হুম্মাম জানিয়েছেন, তাকে আয়নাঘর নামে একটি কুখ্যাত গোপন কক্ষে আটকে রাখা হয়েছিল।

আল জাজিরাকে হুম্মাম কাদের বলেন, ‘সত্যি কথা বলতে এটাকে আয়নাঘর বলা হয়; কারণ এটি এমন একটি জায়গা যেখানে আপনি কাউকে দেখতে পাবেন না। এটা এমনি একটি জায়গা যেখানে আপনি নিজেকে হারিয়ে ফেলবেন।’

আয়নাঘরে নির্যাতনের বিষয়ে তিনি আরও বলেন, ‘তারা যখন খুশি আসে, তুলে নেয়, জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং মারধর করে। এটা একটা মানসিক নির্যাতন।’

শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর জোরপূর্বক গুমের শিকার কয়েকজনকে হঠাৎ ছেড়ে দেয়া হয়। তাদের একজন আবদুল্লাহিল আমান আযমী। দীর্ঘ আট বছর আয়নাঘরে আটকে রাখার পর গত বছরের ৭ আগস্ট তাকে একটি রাস্তায় ছেড়ে দেয়া হয়।

আল জাজিরাকে তিনি বলেন, ৬৯ হাজার ৭৯৪ ঘণ্টা আমি আটক ছিলাম। আমি রাতে কখনো ঘুমাতে পারতাম না। প্রতি রাতে উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা। একটু শব্দ হলেই আমি ভয় পেতাম। ওরা কি আমাকে নিয়ে যেতে আসছে? আমি শুধু ভোরের অপেক্ষা করতাম। কারণ আমি মনে করতাম, তারা আমাকে দিনের বেলায় হত্যা করবে না।

আযমি আরও বলেন, ‘আটক থাকা অবস্থায় আমি প্রকৃতিক আলো দেখিনি, সূর্য, চাঁদ, আকাশ, মেঘ কিছুই দেখিনি।’

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন ব্রিগেডিয়ার হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও কোনো কারণ ছাড়াই ২০০৯ সালে জেনারেল আযমিকে বরখাস্ত করা হয়। এবং এর সাত বছর পর তাকে কোনো অভিযোগ ছাড়াই আয়নাঘরে আটকে রাখা হয়।

নিজ দেশে নির্যাতন-নিপীড়ন সত্ত্বেও শেখ হাসিনা বিশ্ব থেকে অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা পেতে থাকেন। ভয়ে হাসিনার বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে সাহস পেত না। কিন্তু ২০২৪ সালের জুন মাস এসে প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হয়ে যায়। চাকরিতে কোটা নিয়ে ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর বাংলাদেশ সরকারের জারি করা পরিপত্র সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ অবৈধ ঘোষণার পর ছাত্ররা বিক্ষোভ শুরু করেন।

জুলাই মাসে একপর্যায়ে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে আন্দোলনকারীদের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ শুরু হয়। এতে শত শত মানুষ প্রাণ হারায়। ৫ আগস্ট বিক্ষোভকারীরা শেখ হাসিনার বাসভবন ঘেরাও করে। এর মধ্যেই তিনি ভারতে পালিয়ে যান।

তথ্যচিত্রে উঠে এসেছে, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভূমিকা এবং জনগণের প্রতি তাদের সহমর্মিতার চিত্র। সেনাবাহিনীর ভূমিকা বিশেষভাবে প্রশংসিত হয় আন্দোলনকারীদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য।

অন্তর্বর্তী সরকারের ধারণা, বিগত সরকারের মন্ত্রী, ঘনিষ্ঠরা বাংলাদেশ থেকে অন্তত ১৬ বিলিয়ন ডলার পাচার করেছে।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, শেখ হাসিনার শাসনব্যবস্থা এবং তার দোসররা আক্ষরিক অর্থেই ব্যাংক ডাকাতি করেছিল, কখনো কখনো অস্তিত্ব নেই এমন কোম্পানিগুলোকেও কোটি কোটি ঋণ দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিল।

তিনি বলেন, ‘আমার ২৮ বছরের আইএমএফের কর্মজীবনে কখনো দেখিনি যে, বেসরকারি খাতের অভিজাতদের ওপর রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের মাধ্যমে পুরো ব্যাংকিং ব্যবস্থা দখল করা সম্ভব হয়েছে। শুধু ওই ব্যাংকগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যই নয়, নিয়ন্ত্রণ ও ডাকাতির জন্য এমনটি করা হয়েছে।’

শেখ হাসিনার আমলের অনেক মন্ত্রী, এমপি এখন বিদেশে বিলাসী জীবন যাপন করছেন। তাদের একজন সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী।

সাবেক এই ভূমিমন্ত্রীর বার্ষিক বেতন ছিল ১৫ হাজার ডলারেরও কম। কিন্তু লন্ডনে অর্ধ মিলিয়ন ডলারের বেশি সম্পত্তির খোঁজ পেয়েছে আল জাজিরার একটি অনুসন্ধানী দল। তথ্য বলছে, সাইফুজ্জামান চৌধুরী যুক্তরাজ্যে ২৫০ মিলিয়ন ডলার খরচ করে ৩৬০টি বিলাসবহুল বাড়ি কিনেছেন। বিশ্বের অন্যান্য দেশে তার আরও সম্পদ রয়েছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়।

 

এসি//

 

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন আল জাজিরা | ড. ইউনূস