আর্কাইভ থেকে দেশজুড়ে

জলবায়ু পরিবর্তন: দক্ষিণাঞ্চলের নদীর পানিতে বেড়েছে লবণাক্ততা

জলবায়ু পরিবর্তন: দক্ষিণাঞ্চলের নদীর পানিতে বেড়েছে লবণাক্ততা

জলবায়ু পরিবর্তন,শুষ্ক মৌসুমে উজানের পানি কম প্রবাহিত হওয়া আর সঠিক সময়ে বৃস্টিপাত না হওয়ার কারণে দক্ষিণাঞ্চলের নদী সমূহের পানিতে বেড়েছে লবণাক্ততা। 

হঠাৎ করে গত কয়েকদিন ধরে কীর্তনখোলা,সুগন্ধ,বিষখালীসহ বিভিন্ন নদী সমূহের মিঠাপানিতে স্বাভাবিকের তুলনায় লবণাক্ততা বেড়েছে কয়েকগুন। এতে করে জীববৈচিত্রের ওপর বিরুপ প্রভাবের পাশাপাশি পরিবেশ বিপর্যয়ের শঙ্কা রয়েছে বলে মনে করছেন পরিবেশবিদ ও বিশেষজ্ঞরা।

বরিশাল বিভাগীয় পরিবেশ অধিদপ্তর কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২০ সাল থেকে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত কীর্তনখোলা নদীর পানির ইলেক্ট্রিক্যাল কন্ড্যাকটিভিটি (তড়িৎপরিবাহিতা) কম থাকলেও মার্চ মাসে বেড়ে যায় কয়েকগুন। 

আরো জানা গেছে, চলতি বছরের ৭ ফেব্রুয়ারীতে কীর্তনখোলা নদীর ৬টি স্পট থেকে পানি সংগ্রহ করা হয়। যার পরীক্ষা করে পানিতে তড়িৎপরিবাহিতা ৩১৪ থেকে ৩৪০ মাইক্রোসিমেন্স পার সেন্টিমিটার পাওয়া গেছে। এর আগে ৩ থেকে ৪ শত মাইক্রোসিমেন্স পার সেন্টিমিটারের মধ্যেই পাওয়া যায়। সেখানে মার্চ মাসে পাওয়া গেছে ১৩৩১-১৩৬২ পর্যন্ত। যা মানদণ্ডের থেকেও অনেক বেশি। 

এদিকে পরীক্ষায় ফেব্রুয়ারি মাসের থেকে মার্চ মাসে তাপমাত্রা বেশি থাকলেও, অম্লতা এবং ক্ষারের পরিমান নির্দেশ করা পিএইচ এর পরিমান ঠিক ছিলো।

বরিশাল নগরীর কীর্তনখোলা নদীর পাড় সংলগ্ন ভাটারখাল,ডিসিঘাট ও বঙ্গবন্ধুর কলোনির একাধিক বাসিন্দারা জানান, বিগত ৫০ বছরেও কীর্তনখোলা নদীর পানি লবণাক্ত স্বাদ পায়নি তারা। শুধু পানি লবণই নয়, গোসল করার পর চুলগুলো কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে, যা আগে হয়নি। 

আরো জানান, শহরের ভেতর থেকে বয়ে আসা খালের মুখের পাশের জায়গাতে নদীর পানি লবণাক্ত। আশেপাশের চায়ের দোকানগুলোতেও চায়ের স্বাদ লবণাক্ত । 

ঝালকাঠীর সুগন্ধা নদীর পাড়ের বসবাসরত মোঃ শাহাদত হোসেন জানান, গত শুক্রবার রাতে এশার নামাজের ওযু করতে গিয়ে মুখে পানি নিয়ে দেখি পানি লবণাক্ত । তার পরে কয়েকজন ডাক দিলে তারাও পানি মুখে নিয়ে দেখে লবণাক্ত। 

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন ও নদী বাঁচাও আন্দোলন বরিশাল বিভাগীয় সমন্বয়কারী রফিকুল আলম  জানান, বিগত ২০১০-২০১২ সাল পর্যন্ত দুই বছরের একটি সার্ভে দেখা গেছে,শুষ্ক মৌসুমে সাগরের পানি তেঁতুলিয়া নদী পর্যন্ত চলে আসছে। তখন পরিবেশ অধিদপ্তরসহ দায়িত্বশীল সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে বিষয়টি জানানো হয়েছে।

 সে অনুযায়ী তাদের কে ভাবতেও বলা হয়েছিলো। এখন আবার স্থানীয় নদী সমূহের পানিতে লবণাক্ততার অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এজন্য কীর্তনখোলাসহ বাকি নদীগুলোর পানি পরীক্ষা করে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে পরিবেশ অধিদপ্তরকে। তা না হলে আমাদের জলজ সম্পদের ক্ষতি হবে, পাশাপাশি মানুষের জীবন-জীবিকার ওপর বিরুপ প্রভাব পড়বে। 

বরিশাল বিভাগীয় পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারি বায়োকেমিস্ট মোঃ মুনতাসির রহমান জানান, পানিতে তড়িৎপরিবাহিতা ১২০০ পর্যন্ত আমরা সাধু পানি বলতে পারি। তবে এটা ওভার হয়ে গেলে সেটা অনেক লবনাক্তই বলা হয়। কীর্তনখোলা নদীর পানিতে ফেব্রুয়ারি পানিতে তড়িৎপরিবাহিতার পরিমান কম থাকলেও মার্চ মাসে তা বেড়ে ১৩৬২ তে পৌছায়। 

তিনি আরো বলেন, কয়েকমাস পূর্বে পিরোজপুরের বলেশ্বর নদীতে এমন সমস্যা হয়েছিলো। সেখানে এমন অবস্থা ছিলো তিন মাস।

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কোস্টাল স্ট্যাডিজ অ্যান্ড ডিজস্টার ম্যানেজমেন্ট বিভাগের চেয়ারম্যান ডক্টর মোঃ হাফিজ আশরাফুল হক জানান, জলবায়ু পরিবর্তন, শুষ্ক মৌসুমে উজানের পানি কম প্রবাহিত হওয়া আর সঠিক সময়ে বৃস্টিপাত না হওয়ার কারণে ফেব্রুয়ারির তুলনায় মার্চে উপকূলীয় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলসহ দক্ষিণাঞ্চলের নদী সমূহের পানিতে লবণাক্ততা বেড়েছে কয়েকগুন।  

 বৃষ্টিপাত হলে স্বাভাবিকভাবেই স্যালাইনিটি লেভেল কমে যেতো। তবে দুই মাসের পরীক্ষার ফলাফল এটা নিশ্চিত করে বোঝায় না যে এটা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।

তিনি আরো জানান,তড়িৎ পরিবাহিতা বেড়ে যাওয়াতে কি ধরনের ক্যামিক্যাল কম্পোজিশনগুলো বেড়েছে সেগুলোও জানতে হবে, তাহলে বোঝা যাবে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ার মূল কারণ কী?।
 লবণাক্ততা আরো বেড়ে গেলে নদী সমূহে বসবাসকারী প্রাণীর গ্রোথ হ্যাম্পারসহ অনেক প্রজাতি হারিয়ে যেতে পারে। 

এছাড়াও ইলিশসহ নানা ধরনের মাছের উৎপাদনেও প্রভাব ফেলতে পারে, তবে সেটা এখনো নিশ্চিত করে বলা যাবে না। নির্ভর করবে নদীর লবণাক্ত পানির উপর। তাছাড়া এই লবণাক্ত পানি পান করলে মানুষের কিডনি ড্যামেজ সহ নানা রোগ হতে পারে বলেও মনে করছেন এই বিশেষজ্ঞ।

পরিবেশ অধিদপ্তর বরিশাল বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) কামরুজ্জামান সরকার জানান, প্রতি মাসেই বরিশাল বিভাগের ১৫টি নদীর পানি পরীক্ষা করা হয়। ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পানির পরীক্ষার প্রাপ্ত ফলাফলে তড়িৎপরিবাহিতা ও স্যালাইনিটির প্যারামিটারগুলো সীমার মধ্যে রয়েছে।

 কিন্তু মার্চ মাসে ড্রামাটিক্যালি তড়িৎ পরিবাহিতার মান অনেক বেড়ে গেছে। আমরা বিষয়গুলো লক্ষ করছি, তাই ঘন পানির স্যাম্পল সংগ্রহ ও পরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

মইনুল

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন জলবায়ু | পরিবর্তন | দক্ষিণাঞ্চলের | নদীর | পানিতে | বেড়েছে | লবণাক্ততা