ঢাকার গুলিস্তান থেকে ঠাটারি বাজারের দিকে কিছু দূর এগোলেই নবাবপুর সরকারি উচ্চবিদ্যালয়। মূল ফটকের সামনের রাস্তায় যানবাহনের জট আর বাজারের হট্টগোল। স্কুল ভবনের চারপাশেই কাঁচাবাজার আর কারখানা। যানবাহন চলাচলে ধুলা ঢুকছে বিদ্যালয়ের ভেতর। এ অবস্থায় শিক্ষার্থীরা ক্লাস করছে।
বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র আকাশ জানায়, স্কুলে আসা ও যাওয়ার পথে ধুলা খেতে হয়। ক্লাসের মধ্যেও ধুলা আর ধোঁয়ার যন্ত্রণা। কোনো না কোনো ক্লাসের কেউ না কেউ ঠান্ডা–কাশিতে ভুগছেই উল্লেখ করে শিশুটি জানায়, আগে শীতকালে বাতাস খারাপ থাকত। এখন সারা বছরই ধুলা খেতে হয়।
খুদে এই শিক্ষার্থীর বক্তব্যের প্রতিফলনই ঘটেছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল সেন্টার ফর ক্লিন এয়ার রিসার্চ, যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও হিউস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ গবেষণায়।
চলতি ফেব্রুয়ারি মাসে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকী এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ কমিউনিকেশন–এ প্রকাশিত ওই গবেষণা বলছে, শিশুরা দিনের ১৭ শতাংশ সময় কাটায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। যে কারণে শ্রেণিকক্ষ ও খেলার মাঠের পরিবেশ সাধারণভাবে নিরাপদ থাকার কথা। কিন্তু রাজধানী ঢাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রাঙ্গণ দূষিত বায়ু ও বিষাক্ত গ্যাসে ভরে উঠছে।
গবেষণায় বিদ্যালয়গুলোতে মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণা পিএম-১, পিএম ২.৫ ও পিএম ১০ পরিমাপ করা হয়। আর ক্ষতিকর গ্যাসের মধ্যে নাইট্রোজেন ডাই–অক্সাইড, ভোলাটাইল অর্গানিক ও কার্বন ডাই–অক্সাইডের পরিমাণ পরীক্ষা করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মানমাত্রার চেয়ে সর্বোচ্চ প্রায় তিন গুণ (২ দশমিক ৯) বেশি পাওয়া গেছে। গবেষণায় বলা হয়েছে, ডব্লিউএইচওর মানমাত্রা হচ্ছে প্রতি ঘনমিটার বাতাসে ৪৫ মাইক্রোগ্রাম পিএম ১০ থাকতে হবে, পিএম ২.৫ থাকবে ১৫ মাইক্রোগ্রাম। এর চেয়ে বেশি থাকলে তা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। শ্রেণিকক্ষে হেজারডাস বা আপদ পর্যায়ের গ্যাস ও মারাত্মক ক্ষতিকর পর্যায়ের দূষিত বায়ু পাওয়া গেছে।
গবেষণা দলের অন্যতম সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের শিক্ষক শতাব্দী রায় বলেন, আমাদের দেশে স্কুলগুলোর বেশির ভাগই প্রধান সড়ক ও বাণিজ্যিক এলাকার গলির মধ্যে। যে কারণে বাতাস প্রবাহের জায়গা কম। আবার দূষিত বাতাস সহজে স্কুলে প্রবেশ করে আর বের হতে পারে না। যার শিকার হচ্ছে শিশুরা।
যে ১০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর গবেষণাটি করা হয়েছে, নবাবপুর সরকারি উচ্চবিদ্যালয় সেগুলোর একটি। বাকিগুলো হলো কমলাপুর হাইস্কুল, নিউ মডেল বহুমুখী হাইস্কুল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থিত ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি হাইস্কুল, খিলগাঁও গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মতিঝিল মডেল হাইস্কুল, মানিকনগর মডেল হাইস্কুল, আহমেদাবাগ হাইস্কুল ও বাড্ডা হাইস্কুল।
গবেষণায় শ্রেণিকক্ষে থাকা ২৫০ জন শিশুর শ্বাস–প্রশ্বাস নেয়ার স্বাভাবিক ক্ষমতা পরীক্ষা করা হয়। নিশ্বাস পরিমাপ করার বিশেষ যন্ত্র ফ্লো মিটার দিয়ে করা ওই পরীক্ষায় ৪০ শতাংশ শিশু স্বাভাবিকভাবে শ্বাস–প্রশ্বাস নিতে পারেনি। আর বেশির ভাগ শিশুর বায়ুদূষণজনিত কোনো না কোনো সমস্যা পাওয়া গেছে।
পঞ্চম থেকে সপ্তম শ্রেণিতে পড়া এবং ৯ থেকে ১২ বছর বয়সী এসব শিশুর মধ্যে দৈবচয়নের ভিত্তিতে জরিপটি করা হয়। তাতে দেখা যায়, তারা ঠান্ডা, কাশি, সর্দি, জ্বর, মাথাব্যথাসহ নানা সমস্যায় ভুগছে। দূষিত বায়ু ও গ্যাসের কারণে তাদের ফুসফুস ঠিকমতো কাজ করছে না বলে গবেষকেরা মনে করছেন।
জানতে চাইলে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত বলেন, আমরা ঢাকার ৪৫২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মেরামত এবং সৌন্দর্যবর্ধনের উদ্যোগ নিয়েছি। সেখানে বাতাস চলাচলের জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রাখা এবং বায়ুদূষণ রোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে। এ ছাড়া দেশে নতুন যে বিদ্যালয়গুলো নির্মিত হচ্ছে, সেখানে বায়ুদূষণের বিষয়টিকে বিবেচনায় নিয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
২০১৮ সালের এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ছয় মাস ধরে গবেষণাটি পরিচালনা করা হয়। প্রতি দুই দিনে একবার চার ঘণ্টা করে বায়ুর মান পরিমাপ করা হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণা বাতাসের সঙ্গে শ্রেণিকক্ষে ঢুকছে। বাতাস বের হওয়ার জন্য পর্যাপ্ত জানালা, দরজা ও ভ্যানটিলেশন (ঘুলঘুলি) না থাকায় কক্ষগুলোতে তা আটকে থাকছে।
গবেষক দলের অন্যতম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আবদুস সালাম বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো শিশুদের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ করে গড়ে তুলতে হবে।