ড্যান্স ক্লাবের মাধ্যমে শতাধিক নারী বিদেশে পাচার

রাজধানীর মিরপুর, উত্তরা, তেজগাঁও ও চুয়াডাঙ্গা থেকে ২৯ অক্টোবর সন্ধ্যা থেকে ৩০ অক্টোবর সকাল পর্যন্ত বিদেশে পাচার হতে যাওয়া ২৩ জন নারী ভুক্তভোগীকে উদ্ধার করা হয়। এসময় পৃথক নারী পাচারচক্রের প্রধান অভিযুক্তসহ ১১ জনকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব।

শনিবার (৩০ অক্টোবর) দুপুরে মিরপুর র‌্যাব-৪ কার্যালয়ে এসব তথ্য জানান র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

গ্রেফতাররা হলেন- ভারতে পাচারচক্রের মূলহোতা কামরুল ইসলাম ওরফে জলিল ওরফে ডিজে কামরুল বা ড্যান্স কামরুল, রিপন মোল্লা, আসাদুজ্জামান সেলিম, নাইমুর রহমান। এছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে নারী পাচারচক্রের বাকি সদস্যরা হলেন- নুর নবী ভুইয়া রানা, আবুল বাশার, আল ইমরান, মনিরুজ্জামান, শহিদ শিকদার, প্রমোদ চন্দ্র দাস ও টোকন।

অভিযানে ৫৩টি পাসপোর্ট, ২০টি মোবাইল, বিদেশি মদ, ২৩ ক্যান বিয়ার, দুটি মোটরসাইকেল উদ্ধার করা হয়।

২০০১ সালে কুমিল্লা থেকে ঢাকায় আসেন কামরুল ইসলাম ওরফে জলিল ওরফে ডিজে কামরুল ড্যান্স কামরুল (৩৭)। রাজধানীতে এসেই শুরু করেন রিকশা চালানো। এরপর কৌতূহলবশত ২০১৬ সালে এফডিসি ও বিভিন্ন শুটিং স্পটে আসা-যাওয়া শুরু তার।

শুটিং দেখে প্রতিষ্ঠা করেন কথিত ‘ড্যান্স ক্লাব’। সেখানে তরুণীদের নাচ বা গান শেখানোর আড়ালে ব্ল্যাকমেইলের মাধ্যমে তাদের বিভিন্ন অনৈতিক কাজে বাধ্য করেন। তার ক্লাবের মাধ্যমে অনেককে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে পাচারও করা হয়। এরই মধ্যে দুজন নারী দেশটির কারাগারে রয়েছেন। কামরুল ড্যান্স ক্লাব বা সেলুনে কাজের প্রলোভন দেখিয়ে প্রায় শতাধিক নারীকে ভারতে পাচার করেছেন।

কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, আমরা জানতে পেরেছি, পার্শ্ববর্তী দেশে মানবপাচারকারী চক্রের মূলহোতা কামরুল ইসলাম জলিল ওরফে ডিজে কামরুল বা ড্যান্স কামরুল। এই চক্রে প্রায় ১৫-২০ জন সদস্য রয়েছে। ২০১৯ সাল থেকে চক্রটি সক্রিয়ভাবে মানবপাচার অপরাধে জড়িত। চক্রটি দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে কম বয়সী তরুণীদের প্রতারণামূলক ফাঁদে ফেলে ও প্রলোভন দেখিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার করেন।

প্রথমে চক্রটি ভিকটিমদের নাচ বা ড্যান্স শেখানোর নামে প্রত্যন্ত অঞ্চলের থেকে সুন্দরী মেয়েদের ঢাকায় নিয়ে আসতো। পরে তাদের বেপরোয়া জীবনযাপনে অভ্যস্ত করা হতো। পরে তাদের পার্শ্ববর্তী দেশে বিভিন্ন চাকরিতে প্রলুব্ধ করে পাচার করতো চক্রটি। এভাবে চক্রটি তিন বছরে প্রায় শতাধিক মেয়েকে পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার করেছে।

তিনি আরও বলেন, ভিকটিমদের পার্শ্ববর্তী দেশের মার্কেট, সুপারশপ, বিউটি পার্লারসহ লোভনীয় চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে আকৃষ্ট করা হতো। মূলত পার্শ্ববর্তী দেশে অমানবিক ও অনৈতিক কাজ করানোর উদ্দেশ্যে তাদের পাচার করতো। এই চক্রটি রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বেশ কয়েকটি এলাকায় সক্রিয় রয়েছে।

২০০১ সালে কুমিল্লা থেকে ঢাকায় আসেন তিনি। এরপর বাড্ডা এলাকায় রিকশাচালক হিসেবে কাজ শুরু করেন। কয়েকদিন পর তিনি একটি কোম্পানির ডেলিভারি ভ্যানচালক হিসেবে কাজ নেন। এরপর ড্যান্স গ্রুপের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। পরে হাতিরঝিল এলাকায় ‘ডিজে কামরুল ড্যান্স কিংডম’ নামে একটি ড্যান্স ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন। এই ক্লাবের মাধ্যমে উঠতি বয়সী নারীদের বিনোদন জগতে প্রবেশের নামে প্রলুব্ধ করতেন তিনি। একপর্যায়ে তাদের উচ্চ বেতনে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে প্রলুব্ধ করে পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার করতেন।

র‌্যাব আরও জানায়, কামরুলের মাধ্যমে এক নারীকে ভারতে পাচারের ঘটনায় তার বোন বাড্ডা থানায় মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে মামলা করেন। সেই মামলায় ২০১৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে পুলিশ তাকে আটক করে। তিনমাস পর কারাগার থেকে বের হয়ে পুনরায় নারী পাচারে জড়িয়ে পড়েন তিনি। এসব নারীদের সীমান্তবর্তী জেলায় অবস্থিত সেফ হাউজে রাখা হতো। পরে সেফ হাউজে থাকা অবস্থায় তাদের মোবাইল নিয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা হতো। এরপর সুবিধাজনক সময়ে চক্রের সদস্যরা নারীদের অরক্ষিত সীমান্ত দিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার করতো। এই চক্রের গ্রেফতার রিপন, সেলিম ও শামীম নারী পাচারের অবৈধ কাজে মূলহোতাকে সহায়তা করতো বলে স্বীকার করেছে।

গ্রেফতারকৃত মোঃ নুর-নবী ভুইয়া রানা লক্ষীপুরের স্থানীয় একটি কলেজ হতে ১৯৯৬ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। ১৯৯৬ সালে সে ঢাকায় এসে একটি প্রাইভেট কোম্পানীতে চাকুরী দিয়ে কর্মজীবন শুরু করে। পরবর্তীতে ১৯৯৮ সাল হতে তিনি সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং ওমানে প্রবাসী হিসেবে কাজ করে। ওমানে থাকা অবস্থায় মানব পাচারকারী একটি চক্রের সাথে তার পরিচয় হয় এবং তখন থেকেই মানব পাচার কার্যক্রমের সাথে জড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে ২০২০ সালে ওমান থেকে দেশে ফিরে মানবপাচারের সাথে পুরোপুরি জড়িয়ে পড়ে। গ্রেফতারকৃত আবুল বাশার, ইমরান, মনিরুজ্জামান, শহীদ এবং প্রোমদ এই চক্রের স্বক্রিয় সদস্য এবং নুর নবী ভ‚ইয়ার নেতৃত্বে মানব পাচারের এই অবৈধ কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়ে। 

পার্শ্ববর্তী দেশে মানব পাচার চক্রের মূলহোতা ডিজে কামরুল এর নামে ডিএমপি, বাড্ডা থানায় মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে ০১টি মামলা রয়েছে। এছাড়া অপর চক্রের সদস্য মনিরুজ্জামান এর নামে ডিএমপি, সবুজবাগ থানায় বাংলাদেশ পাসপোর্ট আইনে, প্রমদ এর নামে ডিএমপি, পল্টন থানায় প্রতারণার এবং টোকন এর নামে যশোর জেলার অভয়নগর থানায় প্রতারণা ও জালিয়াতির ০১টি করে মামলা রয়েছে।

Recommended For You