বাংলাদেশ-ভারতের এফওসি বৈঠক, দিল্লির দিকেই সবার চোখ
ভারতের রাজধানী নয়া দিল্লিতে পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠক-ফরেন অফিস কনসালটেশন (এফওসি)অনুষ্ঠিত হবে।শুক্রবার (২৪ নভেম্বর) এই বৈঠকে যোগ দিতে এরই মধ্যে দিল্লিতে অবস্থান করছেন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন।আসছে ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দুই দেশের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের এই বৈঠক নিয়ে নানা আলোচনা চলছে। সাবেক কূটনৈতিক ও সংশ্লিষ্টরা এই সফরের রাজনৈতিক তাৎপর্য রয়েছে বলে মনে করছেন।
বৈঠকে বাংলাদেশের নির্বাচন ইস্যু থাকবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে সোমবার (২০ নভেম্বর)পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেছিলেন, এটি(এফওসি)রুটিন ওয়ার্ক (নিয়মিত বৈঠক)।দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ও বিষয় নিয়েই আলোচনা হবে। রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও নির্বাচন নিয়ে আলাপ হবে না।’
ওই সংবাদ সম্মেলনে তিনি আরও বলেন, ‘নির্বাচন নিয়ে তো আলাপ হয়েই গেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তো আগেই আলোচনা করেছেন। ভারত বিশ্বে সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ। তারা এই অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা চায়।’
কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, শুক্রবার (২৪ নভেম্বর)দুদেশের মধ্যে পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকে মাসুদ বিন মোমেন বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেবেন।ভারতের পক্ষে নেতৃত্ব দেবেন দেশটির পররাষ্ট্র সচিব বিনয় কোয়াত্রা।দিল্লি সফরকারে নির্বাচন নিয়ে ভারতীয় নেতাদের সঙ্গে শলাপরামর্শ হতে পারে।
এছাড়া, ভারতে অবস্থানরত বিদেশি ৯০টি দূতাবাস ও মিশনের দূতদের সঙ্গে বৈঠকে বসবেন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন। সেখানে তিনি আসন্ন নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের অবাধ ও নিরপেক্ষ প্রতিশ্রুতির কথা তুলে ধরবেন বলে কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে।
এবিষয়ে বুধবার(২২ নভেম্বর)পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মাসুদ বিন মোমেন জানান, ‘৯০টা দেশের দিল্লিতে দূতাবাস আছে, বাংলাদেশে নেই। তাদের সঙ্গে আমি মিলিত হব দিল্লিতে। তাদের সঙ্গে একটা সেশনে ইন্টারএকশন করব। সেখানে আমরা এসব মিশন প্রধানদের আমাদের উন্নয়ন-অগ্রগতির পাশাপাশি বর্তমান পরস্থিতি,আসন্ন নির্বাচনের কথা তুলে ধরব।’
শুধু এই নির্বাচন নয়,২০১৪ সালের নির্বাচনের কিছুদিন আগেও বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠক হয়েছিল। ওইসময় ঢাকা সফরে এসেছিলেন ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং। তখন রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে সুজাতার বৈঠক নিয়ে দেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। তবে এবারের এফওসি বৈঠকে যোগ দিতে প্রধানমন্ত্রীর (শেখ হাসিনা) থেকে আলাদা কোনো বার্তা নিয়ে দিল্লি যাচ্ছেন না বলে স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন।
মাসুদ বিন মোমেন বলেন, ‘আমি মনে করি না, অপ্রয়োজনীয় অন্য কোনো হিডেন (লুকানো) এজেন্ডা আছে। যেহেতু নির্বাচন আছে-তাদের পক্ষ থেকে যদি কোনো জানার থাকে, সেটা তাদের অবহিত করতে পারব। আমি প্রধানমন্ত্রী থেকে আলাদা কোনো বার্তা নিয়ে যাচ্ছি না।’
পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ‘তাদের (বিদেশি দূতদের) বিশেষ করে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে সরকারে প্রতিশ্রুতির কথা বলব। নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতি নিয়ে তাদের ব্রিফ করব। নির্বাচন পর্যবেক্ষণে পর্যবেক্ষকদের বিষয়ে তাদের প্রশ্ন থাকতে পারে। ইতোমধ্যে কমিশন পর্যবেক্ষকদের জন্য তারিখ বাড়িয়েছে।’
রাজনীতি সম্পর্কে পররাষ্ট্র সচিব বলেন,‘ওদের নির্বাচন আছে সামনে। আমাদের নির্বাচন আছে। নির্বাচন পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী দুদেশের মধ্যে যে সম্পর্ক, এটা তো খুবই বহুপাক্ষিক সম্পর্ক; ট্রেড আছে, বিনিয়োগ আছে, পিপল টু পিপল কনটাক্ট আছে, ভিসা ইস্যু আছে-এগুলো যাতে নির্বাচনের পরও স্মুথলি চলতে পারে।’
পররাষ্ট্র সচিবের বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব ও রাষ্ট্রদূত ওয়ালিউর রহমান। পেশাদার এই কূটনীতিক মনে করেন দিল্লির ওই বৈঠকে বাংলাদেশের সরকারপ্রধানের কোনো বিশেষ বার্তা থাকছে না। এফওসি একটা রুটিন মেকানিজম। সেখানে দুদেশের সব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়।
প্রধানমন্ত্রীর সাবেক এই বিশেষ দূত বায়ান্ন টিভিকে বলেন, দিল্লিতে দুই দেশের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকে রাজনীতি, প্রতিরক্ষা, নিরাপত্তা, বাণিজ্য-বিনিয়োগ, কানেক্টিভিটি, জ্বালানি, বিদ্যুৎ ও অভিন্ন নদী সংক্রান্ত, আঞ্চলিক, উপআঞ্চলিক এবং বহুপাক্ষিক সহায়তা সংক্রান্তসহ অগ্রাধিকার বিষয়গুলো আলোচনা হতে পারে। পাশাপাশি দিল্লিতে ৯০টি দেশের রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনারদের সঙ্গে পররাষ্ট্র সচিবের যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে সেখানে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক সমুদ্রবিষয়ক সংগঠন আইএমওতে বাংলাদেশের প্রার্থিতার প্রচারণা চালানোরও একটি সুযোগ থাকবে।
দুই দেশের এফওসি বৈঠক নিয়ে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন বায়ান্ন টিভিকে বলেন, ‘নির্বাচনের আগে এফওসি বৈঠক কোনো বিশেষ বার্তা বহন করে না। আমি পররাষ্ট্র সচিব থাকার সময় ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগেও বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে এফওসি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে।’
এসময় তিনি আরও বলেন, এর আগে চলতি বছরের ১৫ ফ্রেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় দুই দেশের এফওসি বৈঠক। এহিসেবে শুক্রবারের(২৪ নভেম্বর) বৈঠক আরও কয়েক মাস পর হওয়ার কথা থাকলেও বিশেষ প্রয়োজনের তাগিদে এটি কয়েক মাস এগিয়ে আনা হয়েছে। এটি স্বাভাবিক ঘটনার অংশ। তবে ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের আগ্রহের কারণে ভারতের সঙ্গে এই বৈঠকে নির্বাচন গুরুত্ব পাবে বলে তারা মনে করছে। যদিও বাংলাদেশের নির্বাচন ইস্যুতে নিজেদের অবস্থান আগেই স্পষ্ট করেছে ভারত।’
প্রসঙ্গত, গত ১০ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ২+২ মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে বাংলাদেশের নির্বাচন ইস্যুতে ভারত তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে। বৈঠক শেষে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় কোয়াত্রা সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘একটি স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ ও প্রগতিশীল রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে সে দেশের মানুষ যেভাবে দেখতে চায়, সেই ভিশনকে ভারত কঠোরভাবে সমর্থন করে। বাংলাদেশের নির্বাচন সে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় এবং সে দেশের মানুষই তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। বাংলাদেশ নিয়ে আমাদের (যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ভারত) দৃষ্টিভঙ্গি খুবই স্পষ্ট করে তুলে ধরেছি। তৃতীয় কোনো দেশের নীতিমালা নিয়ে আমাদের মন্তব্য করার জায়গা নেই। এক বন্ধু এবং সঙ্গী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সম্মান জানায় ভারত।’
তবে এরও আগে, গত ৮ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বৈঠকেই মূলত ঢাকার ব্যাপারে দিল্লির অবস্থান স্পষ্ট হয়ে যায় বলে করছেন বিশ্লেষকরা।ওই বৈঠকের পরপরই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নিজের সামাজিক মাধ্যম এক্স(সাবেক টুইট) এ বাংলায় বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। গত ৯ বছরে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের অগ্রগতি খুবই সন্তোষজনক।আমাদের আলোচনায় কানেক্টিভিটি, বাণিজ্যিক সংযুক্তি এবং আরও অনেক বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল।’