শারীরিক সম্পর্কে বাধা দেয়ায় জোড়া খুন
গাজীপুরের শ্রীপুরে মা-ছেলে হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন করেছে পুলিশ। এ ঘটনায় গ্রেপ্তার ঘাতক রহমত উল্লাহ (২৯) পুলিশের কাছে হত্যার দায় স্বীকার করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, শারীরিক সম্পর্কে বাধা দেয়ায় মা-ছেলেকে শ্বাসরোধে হত্যার পর ভারতে পালিয়ে যান।
আজ শুক্রবার (১০ ফেব্রুয়ারি) দুপুর ১২টার দিকে শ্রীপুর থানায় সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান কালিয়াকৈর সার্কেলের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার আজমীর হোসেন। এ সময় শ্রীপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উপ-পরিদর্শক (এসআই) আমজাদ হোসেন উপস্থিত ছিলেন।
কালিয়াকৈর সার্কেলের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার আজমীর হোসেন জানান, গেলো ৭ জানুয়ারি বিকেলে শ্রীপুর উপজেলার কেওয়া পশ্চিম খণ্ড গ্রামের দাইপাড়া এলাকায় বসতঘর থেকে রুবিনা (২২) ও তার ছেলে জিহাদের (৪) মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটন ও ঘাতককে গ্রেপ্তারে পুলিশের একাধিক টিম কাজ করে। সর্বশেষ গেলো বুধবার (৮ ফেব্রুয়ারি) দিবাগত রাতে ঝিনাইদহের মহেশপুর সীমান্ত এলাকা থেকে রহমত উল্লাহকে গ্রেপ্তার করা হয়।
গ্রেপ্তার রহমত উল্লাহ গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার বারিষাব ইউনিয়নের কুষদী গ্রামের গিয়াস উদ্দিনের ছেলে। তিনি পরিবার নিয়ে নিহত রুবিনার বাড়ির পাশে ভাড়া থাকতেন। নিহত রুবিনা শ্রীপুর পৌর এলাকার কেওয়া পশ্চিম খণ্ড গ্রামের সিরাজ মিয়ার মেয়ে।
সহকারী পুলিশ সুপার আজমীর হোসেন জানান, বাবার দেয়া জমিতে উপজেলার কেওয়া পশ্চিম খণ্ড গ্রামে আধাপাকা বাড়িতে চার বছর বয়সী ছেলেকে নিয়ে বসবাস করতেন রুবিনা। বনিবনা না হওয়ায় তার স্বামী ঝুমন পার্শ্ববর্তী মুলাইদ গ্রামের রঙ্গিলা বাজার এলাকায় নিজ পরিবারের সঙ্গে থাকতেন। রুবিনার বসতবাড়ির পাশেই পেশায় রংমিস্ত্রি রহমত উল্লাহ ভাড়া থাকতেন। রুবিনার আধা পাকা বাড়িটি রং করার জন্য রংমিস্ত্রি রহমত উল্লাহর কাছে যান রুবিনা। সেখান থেকেই তাদের পরিচয় হয় এবং ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
রুবিনা বাড়ির বাজারসহ অন্যান্য কাজকর্ম রহমত উল্লাহকে দিয়েই করাতেন। তার বাসায় বিভিন্ন সময় লোকজন আসতো দেখে সন্দেহ হয় রহমত উল্লাহর। একপর্যায়ে রুবিনাকে শারীরিক সম্পর্কের প্রস্তাব দেন তিনি। প্রথমে প্রস্তাবে রাজি না হলেও একপর্যায়ে রাজি হন রুবিনা। তবে রাতে বাড়ি আসতে বলে রুবিনা গেট খুলতেন না।
ঘটনার সাত দিন আগে গেলো বছরের ২৮ ডিসেম্বর রুবিনা তার ব্যবহৃত মোবাইল থেকে রহমত উল্লাহকে তলপেটে ব্যথা করার কথা জানিয়ে ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনে এনে দেয়ার জন্য বলেন। বাড়ির পার্শ্ববর্তী পল্লী বিদ্যুৎ মোড়ে গিয়ে দেলোয়ারের ফার্মেসি থেকে সাত দিনের ওষুধ ও নিজে খাওয়ার কথা বলে দুটি ঘুমের ট্যাবলেট কিনে রুবিনার বাড়িতে গিয়ে দিয়ে আসেন রহমত। ৩ জানুয়ারি দুপুর ১টায় রুবিনার বাড়িতে গিয়ে তাকে ঘুমের ওষুধ খাওয়ানোর পর নিজের বাসায় যান তিনি।
ওই দিন রাত ৮টায় রহমত উল্লাহ রাতে খাবার খেয়ে শারীরিক সম্পর্কের জন্য রুবিনার বাসায় গেলে অর্ধ অচেতন অবস্থায় রুবিনাকে খাটের ওপর শুয়ে থাকতে এবং ছেলে জিহাদকে মোবাইলে গেম খেলতে দেখে। পরে জিহাদের ঘুমের অপেক্ষা করতে থাকেন তিনি। রাত ১০টায় জিহাদ ঘুমিয়ে পড়লে খাটে শুয়ে থাকা অর্ধঅচেতন রুবিনার শরীরে হাত দেন রহমত উল্লাহ। এ সময় রুবিনা তাকে বাধা দেন। ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে জিহাদের গায়ের ওপর পড়লে সে ঘুম থেকে জেগে ওঠে। এ সময় রহমত উল্লাহ ডান হাত দিয়ে জিহাদের গলা আর বাম হাত দিয়ে রুবিনার গলা চেপে ধরে। জিহাদ নিস্তেজ হয়ে মারা যায়। পরে রুবিনাকেও গলা টিপে হত্যা করে রহমত উল্লাহ। ঘরে থাকা দুটি স্মার্ট ফোন, ভ্যানিটি ব্যাগে থাকা দুই হাজার ৫০০ টাকা ও রুবিনার পায়ের নুপুর নিয়ে বাইরে থেকে দরজায় তালা লাগিয়ে চলে যা রহমত উল্লাহ। ৭ জানুয়ারি ঘটনাটি জানাজানি হলে তিনি এলাকার মানুষদের সঙ্গে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা শ্রীপুর থানা পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) আমজাদ হোসেন জানান, মা-ছেলের মরদেহ উদ্ধারের পর কোনো ধরনের ক্লু খুঁজে পাচ্ছিল না পুলিশ। নিহত রুবিনার স্বামীকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তাতে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। এছাড়াও হত্যার রহস্য জানতে পুলিশের পক্ষ থেকে বিভিন্ন জায়গায় সোর্স নিয়োগ দেয়া হয়। তদন্তের একপর্যায়ে গোপালগঞ্জ থেকে রুবিনার মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়। সেখান থেকে জানা যায় রহমত উল্লাহ দালালের মাধ্যমে ভারতে পালিয়ে গেছে।
তিনি জানান, রহমত উল্লাহ ভারতের নদীয়া জেলার কৃষ্ণপুর থানার পেপসি কোম্পানিতে নির্মাণ শ্রমিকের কাজ নেন। পরে যশোর সীমান্তে বাংলাদেশের দালালদের মাধ্যমে ভারতের দালালদের সঙ্গে রহমত উল্লাহকে ফিরিয়ে আনতে যোগাযোগ করা হয়। পরে ভারতীয় দালালরা রহমত উল্লাহকে চিহ্নিত করে এবং তার অবস্থান সম্পর্কে জানালে বাংলাদেশের সীমান্তে পৌঁছে দেয়ার জন্য তাদের সঙ্গে চুক্তি করা হয়। সর্বশেষ গত বুধবার (৮ ফেব্রুয়ারি) দিবাগত রাত ৩টায় তাকে ঝিনাইদহের মহেশপুর সীমান্তে পৌঁছে দেন ভারতের দালালরা। সেখান থেকে তাকে গ্রেপ্তার রা হয়।
এসআই আমজাদ জানান, যেদিন তিনি শ্রীপুর এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যান ওই দিন তার পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছিলেন, রহমত উল্লাহকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তুলে নিয়ে গেছে। তবে কারা তুলে নিয়ে গেছে তা তারা জানাতে পারেনি। এ বিষয়টি ছিল রহস্যজনক।
শ্রীপুর থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বলেন, পুলিশি তৎপরতার পর রহমত উল্লাহ ভারতে চলে যান। পরে কৌশলে দুই দেশের দালালদের মাধ্যমে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের তিনি হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছেন। তাকে গাজীপুর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত-২ এর বিচারক এখলাস উদ্দিনের আদালতে পাঠানো হয়েছে।