আর্কাইভ থেকে দেশজুড়ে

শতবর্ষী শতাধিক বটগাছের ছায়ায় বসে যে মেলা

শতবর্ষী শতাধিক বটগাছের ছায়ায় বসে যে মেলা
নরসিংদী সদর উপজেলার পাঁচদোনা ইউনিয়নের সোনর গ্রামের একটি এলাকা দেবালের টেক। শত শতাংশ জমিতে শতবর্ষী শতাধিক বটগাছ যেখানে দাঁড়িয়ে আছে পাশাপাশি। বছরে একবার বটগাছগুলোর পূজা করেন স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন। একদিনের জন্য জৈষ্ঠ্য মাসের দ্বিতীয় দিনে এই পূজা উপলক্ষে বসে যায় মেলা। এমন দিনে বিভিন্ন স্থান থেকে আসা মৌসুমী ও ফেরী ব্যবসায়ীরা হরেক দোকান নিয়ে বসেন । এই গ্রাম ও আশপাশের এলাকার হাজার হাজার লোক এতে অংশ নেন জাত,ধর্ম-বর্ণ মাড়িয়ে। গতকাল বুধবার (১৮ মে) কয়েকশ বছরের ঐতিহ্যের এই মেলা দিনভর অনুষ্ঠিত হয়েছে। জানা যায়, দেবালের টেক ছিল হারাণ পাল নামের এক ব্যক্তির, তাঁর মৃত্যুর পর পালাক্রমে তাঁর নাতির নাতিরা এখন জায়গাটির ঐতিহ্য ধরে রেখে ভোগদখল করছেন। ঠিক কতবছর আগে এই মেলার প্রচলন শুরু হয়েছিল, তা কেউ জানেন না এমনটি তাঁরাও জানিয়েছেন । তার দাদা, তারও দাদার আমলে এই মেলার অস্তিত্ব ছিল এটুকু বলতে পেরেছেন। সোনর গ্রামের স্থানীয়রা বলছেন, বটগাছগুলো কয়েকশ বছর বয়সী । একটি বটগাছ থেকেই ঠিক একশ বটগাছের বিস্তার ঘটেছে এমনটা কথিত । তবে প্রাকৃতিক কারণে বটগাছের সংখ্যা কিছু কমেছে। শত শত বছর ধরে জৈষ্ঠ্য মাসের দ্বিতীয় দিনে স্থানীয় ও আশপাশের লোকজন এই বটগাছগুলোকে পূজা করে আসছেন। এই উপলক্ষেই বসে যায় মেলা। এদিকে  মেলার কোন আয়োজক নেই, তাই দোকানদার বা দর্শ মনার্থী কাউকে কোন দাওয়াত দেয়া হয় না। সবাই স্বতস্ফূর্তভাবেই এখানে আসেন। ভোর ৬টা থেকে থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত চলে এই মেলা। এই মেলা উপলক্ষে গ্রামের বিভিন্ন বাড়ির মেয়েরা নাইয়র আসেন। বাড়িগুলোতে নানা পদের রান্নার আয়োজন হয়। কথিত বিশ্বাস রয়েছে, এই মেলার দিনে ঝড়-বৃষ্টি হবেই। শত বছর ধরে এই দিনে মেলা প্রাঙ্গণে বৃষ্টি হয়ে আসছে। আজও মেলার দিন সকালে একপশলা বৃষ্টি হয়েছে। স্থানীয়দের মধ্যে বিশ্বাস জন্মেছে, প্রতিবছর এ দিনে ভক্তিভরে বটগাছগুলোর পূজা করেন তারা। মেলায় গিয়ে দেখা যায়, বটগাছগুলোর সামনে ত্রিপাল বা প্লাস্টিক পেতে নানা ধরণের মুখরোচক খাবার ও বাহারী পন্যের দোকান সাজিয়ে বসেছেন প্রায় শতাধিক মৌসুমী ব্যবসায়ী। সেখানে বিক্রি হচ্ছে, জিলেপি, মিস্টি, সন্দেশ, নানারকম মোয়া ও পিঠাসহ রকমারি খাবার। এছাড়াও বিক্রি হচ্ছে শিশুদের অনেক ধরণের খেলনা, কসমেটিকস, তৈজসপত্র, বিভিন্ন ধরনের তৈরি পোশাক, মাটি ও বাঁশের তৈরি জিনিসপত্র। শিশু থেকে বৃদ্ধ, বিভিন্ন বয়সী লোকজন মেলা ঘুরে ঘুরে এসব কিনছেন। এছাড়া খাবারের দোকানগুলোতে ভিড় বেশি দেখা গেছে। বিভিন্ন ছাঁচের মাধ্যমে হাতে মেহেদী রঙের ছাপ দিচ্ছিলেন মাহমুদা বেগম নামের এক মধ্যবয়সী নারী। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ৩৫ বছর ধরে এই মেলায় দোকান দিয়ে আসছি। মেলায় আসা কমবয়সী ছেলে-মেয়েরাই আমার কাস্টমার। পছন্দমত ডিজাইনের ছাপ হাতে দেওয়ার পর তাদের মুখের হাসিটা আমার ভালো লাগে। জিলেপির দোকানদার তপন ঘোষ জানান, যেখানেই মেলার খবর পাই, সেখানেই যাই। তবে শত বছরের বেশি পুরোনো এই মেলায় সবাই নিজে থেকেই আসেন। মধ্যে করোনার সময় দুই বছর নামেমাত্র মেলা হয়েছিল। তবে এবার লোকজন ভালোই আসছেন। বিক্রি-বাট্টাও খারাপ না। সায়মা আক্তার নামে দর্শনার্থী জানান, একশ বটগাছ দেখতে এখানে আগেও ঘুরতে এসেছিলাম। এতগুলো বটগাছ একসঙ্গে দেখার একটা আনন্দ আছে। আজ মেলা হচ্ছে, খবর পেয়ে দলবেধে আবার এলাম। মেলায় ঘুরে ঘুরে অনেককিছু খেয়েছি। বিশেষ করে আমের আচার ও জিলেপি। গ্রামীণ পরিবেশে এমন মেলা সত্যিই দারুণ। দেবালের টেকের ভূমিমালিকদের একজন চন্দন কুমার পাল বলেন, এই জমিটির মালিক আমরা কাকাতো-জেঠাতো ভাইয়েরা সবাই। স্থানীয় হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সবাই মিলেই আমরা জৈষ্ঠ্য মাসের ২ তারিখে এই মেলা উদযাপন করি, বটগাছগুলোকে পূজা দিই। এই মেলার প্রচলন কবে থেকে শুরু হয়েছে তা বলতে পারবো না, শুধু বলতে পারবো শত শত বছরের প্রাচীন এই মেলার কথা আমরা পূর্বপুরুষদের কাছে শুনে এসেছি। পাঁচদোনা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বলেন, শত শত বছর ধরে মেলাটির আয়োজন হয়ে আসছে। বটগাছগুলোর বয়সও শত বছরের বেশি। মেলাটির কোন আয়োজক নেই, সবাই স্বতস্ফূর্তভাবে এতে অংশ নেন। স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ গভীর বিশ্বাস থেকে বটগাছগুলোর পূজা করেন।

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন শতবর্ষী | শতাধিক | বটগাছের | ছায়ায় | বসে | মেলা