আর্কাইভ থেকে বাংলাদেশ

তিনদিনের যুদ্ধ শেষে বাবা পেলেন সন্তানের নিথর দেহ

তিনদিনের যুদ্ধ শেষে বাবা পেলেন সন্তানের নিথর দেহ

ফুটপাতে জীবন থাকতে হয় তাদের। মাথা গোজার ঠাঁই নেই। খাওয়া-পড়ার কোনো ঠিক নেই। ছিন্নবস্ত্র। রোদ-ঝড়ে ভিজে ফুটপাতে যাযাবর জীবন কাটানো আলী কাউসারের কাছে তাই জীবনের মূল্যও একপ্রকার মূল্যহীন। সেই জীবনে, খালে হারিয়ে যাওয়া সন্তানের অন্তত মরদেহটি পেতে তিনদিন কেটেছে কঠিন এক যুদ্ধে।

সেই যুদ্ধে তিনি জয়ী হয়েছেন ঠিকই, কিন্তু আজীবনের জন্য হারিয়ে ফেলেছেন কষ্টে বড় করতে থাকা আদরের ধনকে। পেয়েছেন তিনদিন পানিতে ভিজে ফুলে যাওয়া আর বিকৃত চেহারার নিথর দেহ। তাই, সন্তানের মরদেহ নিয়ে অনেকক্ষণ কান্নায় বুক ভাসিয়েছেন নিঃস্ব এই মানুষটি।

ছিন্নমূল কাউসারের ১২ বছরের শিশু কামাল উদ্দিন গত সোমবার (৬ ডিসেম্বর) খালে পড়ে যায় চট্টগ্রাম নগরীর ষোলশহর ভূমি অফিসের পাশে। তারই বয়সী রাকিব উদ্দিনের সাথে খালে খেলনা কুড়াতে নেমেছিলো সে। কিন্তু বৃষ্টির মধ্যে খালে স্রোত থাকায় রাকিব উঠতে পারলেও ভেসে যায় কামাল। সেই শুরু কপর্দকশূন্য বাবার কষ্টকর সংগ্রাম।

সন্তানের খোঁজে নিজেই নেমে পড়েন খালে। অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজি করেও মেলেনি বুকের ধনের সন্ধান। রাত কাটে উৎকণ্ঠায়। এরপর মঙ্গলবারও সকাল সকাল আবারও নামেন খালে। কিন্তু স্রোতস্বীনি খালে সন্ধান মেলা ভার। কোনো উপায়ও খুঁজে পান না। তার অসহায়ত্ব দেখে কেউ একজন জানান ফায়ার সার্ভিসকে।

ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা ছুটে যান বিকেলে। তারাও সর্বশক্তি দিয়ে খুঁজতে থাকেন। কিন্তু খালজুড়ে ময়লা আবর্জনার আস্তরণ এতটাই বেশি, তীব্র বেগ পেতে হয় তাদের। বাবা আলী কাউসারও বুঝে যান আর হয়ত প্রাণ নিয়ে মিলবে না সন্তানের সন্ধান। তাই তার আকুতি বাড়তে থাকে, অন্তত প্রাণহীন দেহটি হলেও যেন খুঁজে দেয়া হয় তাকে।

বুধবারও (৮ ডিসেম্বর) দিনভর খাল চষে বেড়ান অসহায় এই বাবা। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অনেকদূর পর্যন্ত খালে খালে নোংরা পানিতে ঘুরে বেড়ান তিনি। কিন্তু আবারও হতাশ। এরপর বৃহস্পতিবার বেলা বারোটার দিকে আসে সেই চরম দু:সংবাদ। মরদেহ মেলে দেড় কিলোমিটার দূরে, এন মোহাম্মদ কারখানার কাছে, খালে। ছুটে যান সেখানে। চেহারা চেনা না গেলেও পরনের পোশাক দেখে শনাক্ত করেন, এটাই তার আদরের কামালের মরদেহ।

সন্তানের মরদেহ সামনে রেখে অঝোর কান্নায় বুক ভাসান নিঃস্ব এই বাবা। চোখের জলে বুক ভাসান, কামালের সাথে খালে পড়েও বেঁচে যাওয়া শিশু রাকিবও। তাদের এই কান্না ছুঁয়ে যায় সেখানে উপস্থিত ফায়ার সার্ভিস, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যসহ সবাইকে। খানিকটা মানসিক ভারসাম্যহীন হলেও সন্তানের জন্য তার এক অসম্ভব সংগ্রামে চোখ ভিজেছে অনেকের।

কামালের মা নেই। ষোলশহর এলাকায় ফুটপাতে থাকতো বাবার সাথে। কাগজ-প্লাস্টিকসহ নানা পরিত্যক্ত জিনিস কুড়াতো অন্য পথশিশুদের সাথে। তার মৃত্যুতে ভীষণ মুষড়ে গেছে শিশু রাকিবও। কেননা, দুজনই একসাথে খালে নামলেও, চিরতরে হারিয়ে গেছে তার খেলার সাথী কামাল।

সন্তানের মরদেহ সামনে নিয়ে, কান্নাজড়িত কণ্ঠে বাবা আলী কাউসার বারবার বলছিলেন, খালে পড়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ আগেও তাকে শার্ট পড়িয়ে দিয়েছিলেন। সেই শার্টেই মিললো তার মরদেহ। ‘আপনারা আমার সন্তানকে জীবিত এনে দিতে পারলেন না। আমি কাকে নিয়ে বাঁচবো! আমার কামালরে, বাবা তুই কেন গেলি!-তার এই আহাজারি খানিকটা হলেও ছুঁয়ে যায় আকাশকে। কারণ, তখনও টিপ টিপ বৃষ্টি হচ্ছিলো চট্টগ্রামের আকাশে।

এস

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন তিনদিনের | যুদ্ধ | শেষে | বাবা | পেলেন | সন্তানের | নিথর | দেহ