আর্কাইভ থেকে বাংলাদেশ

কোক স্টুডিও বাংলা নিয়ে যত তর্ক- বিতর্ক

কোক স্টুডিও বাংলা নিয়ে যত তর্ক- বিতর্ক

ফিউশনধর্মী গানের জন্য দুনিয়াজোড়া খ্যাতি পেয়েছে ‘কোক স্টুডিও’। বিশেষ করে ভারত ও পাকিস্তানে ‘কোক স্টুডিও’ দারুণ সফল। তাদের গান বাংলাদেশেও সমান জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বিশ্বের নানা দেশে এই আয়োজন দীর্ঘদিন ধরে চললেও বাংলাদেশে এই প্রথম ‘কোক স্টুডিও’র সংস্করণ নিয়ে এলো কোকা-কোলা বাংলাদেশ। যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘coke studio বাংলা’।

কোমল পানীয় প্রস্তুতকারী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান কোকা কোলার প্রযোজনায় আয়োজিত ফিউশন ভিত্তিক গান নিয়ে তৈরি টেলিভিশন সিরিজ 'কোক স্টুডিও' বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে 'কোক স্টুডিও বাংলা' নামে যাত্রা শুরু করার পর এই উদ্যোগের পক্ষে বিপক্ষে নানা রকমের আলোচনা সমালোচনা হচ্ছে।

গেল সোমবার (৭ ফেব্রুয়ারি)  ঢাকার একটি হোটেলে আনুষ্ঠানিকভাবে এই উদ্যোগের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান আয়োজন করে কোকা কোলা বাংলাদেশ।

কোক স্টুডিও সাধারণত বিভিন্ন ধরণের সঙ্গীতের সংমিশ্রণ বা ফিউশনের মাধ্যমে গান তৈরি করে থাকে। স্টুডিওতে সঙ্গীতশিল্পী ও কলাকুশলীদের এক একটি লাইভ পারফর্মেন্সের মিউজিক ভিডিও দিয়ে তৈরি হয় টেলিভিশন সিরিজের এক একটি পর্ব।

বাংলাদেশে কোক স্টুডিওর প্রথম সিজনে মোট দশটি পর্ব থাকবে বলে জানিয়েছেন আয়োজকরা।

আর ফিউশনের পক্ষে-বিপক্ষে যত মত: 

জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী দিলশাদ নাহার কণা এই নামটি নিয়েই দারুণ এক্সাইটেড। তিনি গণমাধ্যমকে জানান, কোক স্টুডিও আন্তর্জাতিক আয়োজন। অবশ্যই আমাদের দেশে এমন একটি অনুষ্ঠান চাই যেটি কোক স্টুডিওর যে মান- রয়েছে, সেটিকে যেন নিম্নগামী না করে। তবে একজন বাংলাদেশি হিসেবে আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে আয়োজনটির নামে বাংলা কথাটা বাংলায় লেখায়। এর ফলে আন্তর্জাতিক দর্শকদের বাংলাটা জানতে হবে। নয়তো তারা এটা পড়তেই পারবে না। এভাবেই আমরা শিল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশের সংস্কৃতি, ভাষা, জীবনবোধ তুলে ধরতে পারি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে।

সংগীতশিল্পী সামিনা চৌধুরীও শুরু থেকে যুক্ত এই আয়োজনের সঙ্গে। তিনি জানান, কোক স্টুডিওর ব্যাপারটি আলাদা। আমার নতুন করে বলার কিছু নেই। এমন একটি উজ্জ্বল ও আন্তর্জাতিক লেগেসির সঙ্গে থাকব না, এটা তো হতেই পারে না। তাই আয়োজকরা আমাকে প্রস্তাব করার পর স্বানন্দ্যে রাজি হয়ে যাই। ‘‘কোক স্টুডিও বাংলা’’র থিম সংয়ে অংশ নিয়েছি। তবে প্রথম সিজনে মনে হয় আমি গাইব না। কারণ এই সিজনে দেশের ফোক গান নিয়েই কাজ হবে। 

অনেকেই এক ধরণের সঙ্গীতের সাথে আরেক ধরণের সঙ্গীতের মিশ্রণের ধারণাটি পুরোপুরি সমর্থন করেন না। তারা মনে করেন, সঙ্গীতে ফিউশনের ফলে লোকজ গান মৌলিকতা হারিয়ে ফেলে।

লোকজ গানের শিল্পী শাহনাজ বেলী জানান, ফিউশন বা মিক্স করার কারণে অনেক সময় গান মৌলিকতা হারায়, লোকজ গান আবেদন হারায় যেটি সমর্থনযোগ্য নয় বলে আমি মনে করি। 
তিনি বলেন, আধুনিক বাদ্যযন্ত্রের সাথে লোকজ গান পরিবেশন করলেও অনেক সময় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়, যেখানে লোকজ গানের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য থাকে না।

পাশাপাশি লোকগানের সাথে প্রথাগত বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার না করে ভিন্নভাবে পরিবেশন করার কারণে লোকগানের শিল্পীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলেও মনে করেন শাহনাজ বেলী।

তিনি জানান, যারা সারাজীবন প্রকৃতির কাছে থেকে লোকগানের চর্চা করেছেন, তাদের একটা বড় অংশ কিন্তু আধুনিক বাদ্যযন্ত্রের সাথে অভ্যস্ত নয়। কিন্তু আজকাল দেখবেন অধিকাংশ অনুষ্ঠানে লোকগানের খুব চাহিদা। অনেক সময়ই এমন হয় যে, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সেসব লোক গান এমন লোকজন পরিবেশন করে - যারা হয়তো ইন্টারনেট দেখে গান শিখেছে, আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে, লোকগানের সাথে হয়তো যাদের সম্পর্ক খুব কম।

এর ফলে অনেক সময় প্রকৃত শিল্পীরা আর্থিকভাবে এবং সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। 

ফিউশনের মাধ্যমে তৈরি করা গানের ভক্তরা জানিয়েছেন ফিউশন করার কারণে তারা আজ অনেক লোকগান তারা শুনেছেন যেগুলো ফিউশন না করা হলে হয়ত তাদের শোনাই হত না।

ভক্তরা আরো জানান, গান তো মানুষ যত শুনবে, তত বেশি প্রসার পাবে, ততদিন টিকে থাকবে। এখন আমার দোতরা, খোল, কর্তাল দিয়ে বাজানো গান ভালো লাগে না। কিন্তু ঐ একই গান যখন আধুনিক যন্ত্র ব্যবহার করে, নতুন রেকর্ডিংয়ে, সুন্দর করে পরিবেশন করা হয় - তখন সেটা ভালো লাগে।

ফিউশনকে এভাবে ভাবা যায়, আমাদের পুরনো গানগুলো হারিয়ে যাচ্ছিল কারণ মানুষ সেগুলো শুনছিল না। সেগুলোকে বাঁচানোর জন্য তার সাথে নতুন অনুষঙ্গ যোগ করার পর মানুষের কাছে, তরুণদের কাছে সেগুলো গ্রহণযোগ্যতা পেল।

কিভাবে শুরু হয়েছিল কোক স্টুডিও : 

উপমহাদেশে এর আগে পাকিস্তান ও ভারতে কোকা কোলার আয়োজনে এই টেলিভিশন সিরিজ আয়োজিত হয়েছে।

পাকিস্তানে ২০০৮ সালে শুরু হয় এই টিভি সিরিজ - ঐ উদ্যোগের সহ আয়োজক ছিল পাকিস্তানের পপ ও রক ব্যান্ড স্ট্রিংস। আর ভারতে ২০১১ সালে শুরু হওয়া সিরিজটির সহ আয়োজক ছিল এমটিভি।

তবে কোকা কোলার আয়োজনে এই ধরণের উদ্যোগ প্রথমে নেয়া হয়েছিল ব্রাজিলে, ২০০৭ সালে। ঐ উদ্যোগটির নাম দেয়া হয় 'এস্তুদিও কোকা কোলা।'

ব্রাজিলের কোক স্টুডিওর আদলে পরের বছর পাকিস্তানে 'কোক স্টুডিও' তৈরি হয়।

২০১১ সালে ভারতে এমটিভি'র সাথে সহ প্রযোজনায় আয়োজন করা হয় কোক স্টুডিও, যার আনুষ্ঠানিক নাম ছিল 'কোক স্টুডিও@এমটিভি।'

এরপর ২০২১ সালে ফিলিপিন্সেও এই উদ্যোগ শুরু করে কোকা-কোলা।

অনুষ্ঠানের নাম নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় যত সমালোচনা: 

ভারতে বা পাকিস্তানে কোক স্টুডিও নামটির সাথে সংশ্লিষ্ট দেশটির নাম আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্ত না থাকলেও ভারতের কোক স্টুডিও ইন্ডিয়া ও পাকিস্তানেরটিকে কোক স্টুডিও পাকিস্তান বলে অনেকে সম্বোধন করেন।

কিন্তু বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিক নামের সাথে বাংলা শব্দটি জুড়ে দেয়ায় অনেকে সমালোচনা করছেন।

অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, এর ফলে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে প্রচলিত অন্যান্য ভাষার গান - বিশেষ করে ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীরা যেসব ভাষা ব্যবহার করে - উপেক্ষিত হবে।

বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক পটভূমি মাথায় রেখেই অনুষ্ঠানের নামের সাথে 'বাংলা' শব্দটি সংযুক্ত করা হয়েছে বলে জানান অনুষ্ঠানের সার্বিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা বিজ্ঞাপনী সংস্থা গ্রে অ্যাডভার্টাইজিং বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও কান্ট্রি হেড গাউসুল আলম শাওন।

তিনি জানিয়েছেন বাংলাদেশ পৃথিবীর একমাত্র দেশ যে দেশের নাম ভাষার নাম থেকে উৎপত্তি। আমাদের দেশের স্বাধিকার আন্দোলনের শুরুটা হয়েছিল ভাষা আন্দোলন থেকে। তাই এটা রাজনৈতিক বা ধর্মভিত্তিক আন্দোলনের চেয়ে বেশি সাংস্কৃতিক আন্দোলন।

তাই কোক স্টুডিও বাংলা বললে আমরা বাংলাদেশের সীমানার ভেতরে থাকা ১৭ কোটি মানুষ নয়, একবারে ৪০ কোটি বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারি।

নামের সাথে বাংলা সংযুক্ত থাকায় ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর সদস্যদের বাদ পড়ার আশঙ্কার অভিযোগের জবাবে শাওন জানান, আমরা প্রথম যেই গানটি রিলিজ করবো, সেটিতেই কিন্তু বাদ্যযন্ত্র বাজানোর জন্য বান্দরবান থেকে শিল্পী আনা হয়েছে। হাজংদের গান থাকবে প্রথম সিজনে। এটা যত সময় যাবে, তাদের অংশগ্রহণের হার তত বাড়বে। কাজেই ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর সদস্যদের বাদ পড়ার ধারণা নিতান্তই অমূলক।

শাওন জানান, এবারের সিজনের প্রথম পর্ব এক সপ্তাহের মধ্যে প্রকাশ করা হবে।

কোকা-কোলা বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তা জি তুং বলেন, বাংলাদেশের মানুষদের জন্য জাদুকরী ও চমৎকার মুহূর্ত সৃষ্টি করে আমরা সবার জীবনকে উপভোগ্য করে তুলতে চাই। বাংলাদেশে আমাদের কার্যক্রমের ৬০তম বছর উদ্যাপন করছি আমরা। এ উপলক্ষে অসাধারণ সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ এই জাতির জন্য প্রথমবারের মতো ‘কোক স্টুডিও বাংলা’ উপহার দিতে পেরে আমরা আনন্দিত। আমরা বিশ্বাস করি, আমাদের পণ্যের মতো এই প্ল্যাটফর্মের সৃষ্টিগুলোও দর্শকদের তৃষ্ণা মেটাতে সক্ষম হবে।

মুক্তা মাহমুদ 

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন কোক | স্টুডিও | বাংলা | নিয়ে | যত | তর্ক | বিতর্ক