আর্কাইভ থেকে বাংলাদেশ

চাঁদাবাজি-ডাকাতি মোশাররফ বাহিনীর পেশা, বাধা পেলেই খুন

চাঁদাবাজি-ডাকাতি মোশাররফ বাহিনীর পেশা, বাধা পেলেই খুন

গ্রুপের নাম ‘গাংচিল গ্রুপ’, পরে নাম পাল্টে হয়ে যায় ‘মোশাররফ বাহিনী’। নামের সাথে সাথে আসে নেতৃত্বেও  পরিবর্তন। । ঢাকার মোহাম্মদপুর, হাজারীবাগ,  আমিনবাজার, তুরাগ, কেরানীগঞ্জ ও সাভার এলাকায় জমি দখল, হাউজিং প্রতিষ্ঠানে, নৌপথে, মার্কেটে, বাসস্ট্যান্ডে চাঁদাবাজি, ছিনতাই ও ডাকাতি যেন হয়ে উঠেছিল নিজেদের অধিকার।
 
রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে মোশাররফ বাহিনীর মূলহোতা ও শীর্ষ সন্ত্রাসী মোশাররফ হোসেন ওরফে লম্বু মোশাররফ ওরফে গলাকাটা মোশাররফ ওরফে গাংচিল মোশাররফসহ তার পাঁচ সহযোগীকে গ্রেফতারের পর এমন তথ্য জানিয়েছে র‍্যাব।

আজ সোমবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‍্যাব মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান সংস্থাটির লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

গ্রেফতাররা হলেন- গলাকাটা মোশাররফ ওরফে গাংচিল মোশারফ (৪৫), সহযোগী বিল্লাল ওরফে বিল্লাল হোসেন ওরফে চোরা বিল্লাল (৩০), মোহন ওরফে বাইক মোহন (৩১), সাহাবুদ্দিন সাবু ওরফে জলদস্যু সাবু (৪৪), রুবেল ওরফে ট্রলার রুবেল (৩৩) ও সুমন মিয়া (৩০)।

তিনি বলেন, ২০১৭ সালে গাংচিল গ্রুপের প্রধান আনারের মৃত্যুর পর গাংচিল গ্রুপ কয়েক ভাগে বিভক্ত হয় এবং তৎকালীন এই গ্যাং-এর সেকেন্ড ইন কমান্ড শীর্ষ সন্ত্রাসী লম্বু মোশাররফের নেতৃত্বে মূল অংশটি পরিচালিত হচ্ছিল।
  
এমন তথ্য গোয়েন্দা কার্যক্রমের ভিত্তিতে নিশ্চিত হওয়ার পর র‍্যাব-২ এর একটি দল রোববার (২৭ ফেব্রুয়ারি) দিবাগত রাতে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে গলাকাটা মোশারফ ওরফে গাংচিল মোশাররফসহ ছয়জনকে গ্রেফতার করে।

অভিযানে জব্দ করা হয় একটি বিদেশি পিস্তল, একটি ম্যাগাজিন, চার রাউন্ড গুলি, তিনটি বড় ছোরা, দুটি চাপাতি, দুটি চাকু, একটি চাইনিজ কুড়াল, একটি দা, একটি ফ্রেমসহ হেসকো ব্লেড, গ্রিল কাটার, ৪২৩ পিস ইয়াবা।

গ্রেফতারদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, কথিত এ মোশারফ বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ২৫-৩০ জন। তারা বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে এসব কর্মকাণ্ড চালাতো।

বাহিনীর সদস্যরা ইটভাটার মালিকের কাছ থেকে মাসিক ভিত্তিতে চাঁদা আদায় করতো। বিভিন্ন হাউজিং এলাকায় নির্মানাধীন ভবন, নতুন বাড়ির মালিক ও ব্যবসায়ীদের কাছে জমি দখলের নামেও চাঁদাবাজি করতো। কেউ চাঁদা দিতে রাজি না হলে বাহিনীর সদস্যরা বিভিন্নভাবে ভয়-ভীতি প্রদর্শন করতো; চাঁদা না পেলে রাতের অন্ধকারে নিরাপত্তাকর্মীকে প্রহার এবং নির্মাণকাজের উপকরণ জোরপূর্বক নিয়ে যেতো।

জমি দখল, চাঁদাবাজি ও অন্যান্য সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনার জন্য গ্যাংয়ের সদস্যরা দেশি ও বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্রসহ অন্যান্য দেশীয় অস্ত্র দ্বারা সাধারণ মানুষকে ভয় দেখাতো। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের এ অপরাধ কর্মকাণ্ডে বাধা দিতে গেলে বিভিন্ন সময় তাদের ওপরও চড়াও হতো।

এছাড়াও আধিপত্য বজায় রাখাসহ অপরাধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে লম্বু মোশাররফ গ্রুপের সদস্যরা একাধিক কিশোর গ্যাং গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ করতো। তারা অধিকাংশ সময় নদীর কাছে আস্তানা গড়ে তুলে এবং নদীপথে ডাবল ইঞ্জিন চালিত ট্রলার ব্যবহার করে যাতায়াত করতো।

এরা কারা ?

বেবি ট্যাক্সিচালক থেকে গাংচিল বাহিনীর প্রধান লম্বু মোশাররফ,
লম্বু মোশাররফ ভোলা জেলার বোরহানউদ্দীন উপজেলার একটি বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করে। ১৯৯০ সালে ঢাকায় আসে। প্রথমে বেবি ট্যাক্সি ও সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতো। পরে হাউজিং প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেয়। ২০০০ সালে রাজধানীর কাফরুল থানা এলাকায় ছিনতাইয়ের মাধ্যমে অপরাধ জগতে প্রবেশের পর এক পর‍্যায়ে হাত মেলায় গাংচিল বাহিনীর প্রধান আনারের সঙ্গে।

২০১৭ সালে আনারের মৃত্যুর পর গাংচিল বাহিনী ভেঙে যায়। তবে বাহিনীর মূল অংশের নেতৃত্ব নিয়ে সেকেন্ড ইন কমান্ড হয় লম্বু মোশাররফ। মারামারিসহ অন্যান্য সন্ত্রাসী কার্যক্রমের সময় ভুক্তভোগীকে গলায় ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করার কারণে ‘গলাকাটা মোশাররফ’ হিসেবে সে পরিচিতি পায়। তার বিরুদ্ধে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় হত্যাচেষ্টা, ছিনতাই, ডাকাতি, অবৈধ অস্ত্র, মাদক ব্যবসা, ধর্ষণ, অপহরণ, পুলিশের ওপর হামলাসহ ১৫টির বেশি মামলা রয়েছে। বিভিন্ন মেয়াদে একাধিকবার কারাভোগও করেছে সে।

চোরা বিল্লাল
গ্রেফতার চোরা বিল্লাল ২০০৬ সালে মুন্সিগঞ্জ থেকে পরিবারের সঙ্গে ঢাকায় আসে। প্রথমে গার্মেন্টসে পরে গাড়ির হেলপার হিসেবে কাজ করে। ২০১৭ সালে লম্বু মোশাররফের সঙ্গে পরিচয়। পরে তার অন্যতম সহযোগী বনে যায়। সিঁধকাটা, গৃহস্থালির তালা ভাঙাসহ অন্যান্য চৌর্যবৃত্তিতে পারদর্শিতার কারণে ‘চোরা বিল্লাল’ নামেও সে পরিচিতি পায়। তার বিরুদ্ধে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় চুরি, ছিনতাই, হত্যাচেষ্টাসহ বিভিন্ন অপরাধে ১০টি মামলা রয়েছে।

বাইক মোহন
গ্রেফতার বাইক মোহন লম্বু মোশাররফের অন্যতম সহযোগী। সে ২০১০ সালে ভোলা হতে ঢাকায় এসে ঢাকা উদ্যান এলাকায় বসবাস শুরু করে। বিভিন্ন সময়ে গার্মেন্টসে চাকরি, রাইড শেয়ারিংয়ের মাধ্যমে মোটরবাইক চালানোর কাজ করতো। পরবর্তীতে ২০১৮ সালে একটি রিয়েল এস্টেটে চাকরির সময়ে লম্বু মোশাররফের দলে যোগ দেয়। ছিনতাই, ধর্ষণ, হত্যাচেষ্টাসহ বিভিন্ন অপরাধে ৮টির বেশি মামলায় একাধিকবার কারাভোগ করেছে সে।

জলদস্যু সাবু
গ্রেফতার জলদস্যু সাবু মোহাম্মদপুর এলাকায় রাজমিস্ত্রীর কাজ করতো। ২০১৭ সালে একটি প্রতিষ্ঠানে চাকুরির সময়ে মোশাররফ বাহিনীতে যোগ দেয়। লম্বু মোশাররফের নির্দেশে সে বুড়িগঙ্গা নদীতে বিভিন্ন মালবাহী নৌকা ও ট্রলারে চাঁদাবাজি, ডাকাতি ও অপহরণের সঙ্গে জড়িত ছিল। তার বিরুদ্ধে সাভার ও মোহাম্মদপুর থানায় বিস্ফোরকদ্রব্য, চাঁদাবাজি, হত্যাচেষ্টা, মাদক, ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধে ৬টি মামলা রয়েছে।

ট্রলার রুবেল
ট্রলার রুবেল ২০০৬ সাল থেকে মোহাম্মদপুরের আশপাশ এলাকায় ট্রলার চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতো। ২০১৮ সালে মোশাররফ বাহিনীতে যোগ দেয়। বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ নদীর বিভিন্ন মালবাহী নৌকা ও ট্রলারে চাঁদাবাজি/ডাকাতির সময়ে সে নৌকা বা ট্রলার চালনা করতো বলে ট্রলার রুবেল হিসেবে পরিচিত। তার বিরুদ্ধে ছিনতাই, ডাকাতিসহ অন্যান্য অপরাধে সাভার ও মোহাম্মদপুর থানায় ৩টি মামলা রয়েছে।

সুমন মিয়া
সুমন মিয়া ঢাকার বাবুবাজার এলাকায় গার্মেন্টসে চাকরি ও ডিসের লাইনে কাজ করেছে। ২০২০ সালে মোশাররফের দলে যোগ দেয়। মাদক সংগ্রহ ও মাদক পৌঁছে দেওয়ার কাজ করতো সে। তার বিরুদ্ধে মোহাম্মদপুর থানায় মাদক ও চাঁদাবাজির অভিযোগ ২টি মামলা রয়েছে।

 

এসআই/

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন চাঁদাবাজিডাকাতি | মোশাররফ | বাহিনীর | পেশা | বাধা | পেলেই | খুন