বাংলাদেশের চিকিৎসা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বড় মাইলফলক। প্রথমবারের মতো টেস্টটিউব শিশুর জন্ম দিয়েছে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)। বুধবার (২৫ অক্টোবর) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সি-ব্লকে মা ও প্রসূতি বিভাগের অপারেশন থিয়েটারে সিজারিয়ান সেকশনের মাধ্যমে প্রথম টেস্টটিউব নবজাতকের জন্ম হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ নিজেই বিষয়টি গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন।
পুরো অপারেশন কার্যক্রম পরিচালনা করেন বিএসএমএমইউর ইনফার্টিলিটি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. জেসমিন বানু। সিজারিয়ান সেকশনে আরো অংশ নেন অ্যানেসথেসিয়া বিভাগের শিক্ষক নার্সিং অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. দেবব্রত বনিক, ডা. মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, নিউনেটোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আব্দুল মান্নান, রিপ্রোডাক্টিভ অ্যান্ডোক্রাইন অ্যান্ড ইনফার্টিলিটি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. ফারজানা দীবা, সহযোগী অধ্যাপক (অনারারী) ডা. শাহীন আরাসহ ১৭ জন চিকিৎসক, পাঁচজন নার্স।
সন্তানধারণে অক্ষম নারীর মা হওয়ার আধুনিকতম উপায় হচ্ছে ‘টেস্টটিউব বেবি’ পদ্ধতি। এর জন্য স্ত্রীর ডিম্বাশয় থেকে ডিম্বাণু সংগ্রহ করা হয় আর স্বামীর শরীর থেকে শুক্রাণু সংগ্রহ করা হয়। গবেষণাগারে সেই ডিম্বাণু ও শুক্রাণু নিষিক্ত করার পর কৃত্রিমভাবে ভ্রুণ সৃষ্টি করা হয়। পরে সেই ভ্রুণ স্ত্রীর গর্ভাশয়ে প্রতিস্থাপন করা হয়। স্বাভাবিক ভ্রুণ যেভাবে গর্ভাশয়ে বেড়ে ওঠে, কৃত্রিম ভ্রুণও একইভাবে বেড়ে উঠতে থাকে। এভাবে ৯ মাস পর যে শিশুর জন্ম হয়, তাকে টেস্টটিউব বেবি বলা হয়।
১৯৭৮ সালের ২৫ জানুয়ারি ইংল্যান্ডে প্রথম টেস্টটিউব শিশুর জন্ম হয়। অনেকেরই ধারণা, এই ধরনের উন্নত চিকিৎসাব্যবস্থার সুযোগ হয়তো পেতে পারেন শুধুমাত্র ধনীরাই। কারণ বেসরকারি হাসপাতালে যাওয়ার ক্ষমতা আম জনতার মধ্যে তুলনায় কম। এমন ধারণা যাঁদের, তাঁদেরই আশার আলো দেখালো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অভিনব ঘটনাটি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, বরিশালের এক নিঃসন্তান দম্পতি দীর্ঘ ১৩ বছর ধরে বন্ধ্যাত্ব সমস্যায় ভুগছিলেন। আট বছর আগে দম্পতির রোগটি ডায়াগনোসিস হয়। বিভিন্ন জায়গায় বন্ধ্যাত্ব সমস্যা নিরসনে চিকিৎসা গ্রহণ করেও কোনো সুফল পাননি। এসময় কারো কাছ থেকে ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশনের (আইভিএফ) সুপরামর্শও পাননি বরিশালের এই দম্পতি।
পরবর্তীতে ২০২২ সালে এই দম্পতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনফার্টিলিটি বিভাগে আসেন। এখানে ইভাউলিউশন শেষে এই বিভাগ তাদের আইভিএফ উইথ আইসিএসআই এর পরামর্শ দেয়। পরে স্টেম সেল থেরাপির গ্রহণের মাধ্যমে তারা এ চিকিৎসা শুরু করেন। যথাযথ চিকিৎসা শেষে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে এই নবজাতকের মা গর্ভধারণ করেন এবং নিয়মিত চেকআপে থাকেন। ৩৮ সপ্তাহের পর সুদীর্ঘ প্রতীক্ষা শেষে বিএসএমএমইউ’র ইতিহাসে সফলতার নিদর্শন স্বরূপ ২৫ অক্টোবর সকাল সাড়ে ৯টায় এ টেস্টটিউব নবজাতকের জন্ম হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো টেষ্ট টিউব নবজাতকের জন্ম নেওয়ার ঘটনায় উচ্ছ্বাসিত প্রতিষ্ঠানটির ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ডা. মোঃ শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, বিএসএমএমইউয়ে এ টেস্টটিউব নবজাতকের জন্মগ্রহণের মাধ্যমে আরেকটি সফলতার পালক যুক্ত হলো। নিঃসন্তান দম্পতিদের দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটানোর জন্য সব সময় কাজ করছে বিএসএমএমইউয়ের ইনফার্টিলিটি বিভাগ। টেস্টটিউব নবজাতকের জন্মগ্রহণে নিঃসন্তান দম্পতিদের সহযোগিতার জন্য বিএসএমএমইউ সামনের দিনগুলোতে আজকের দিনটি অনুপ্রেরণা যোগাবে। এর মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধ্যাত্ব বিভাগের বিশেষজ্ঞরা ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রিপ্রোডাক্টিভ এন্ডোক্রাইন এন্ড ইনফার্টিলিটি বিভাগের প্রধান জানান, সাধারণত বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসায় শতকরা ৫-১০% রোগীদের আইভিএফ পদ্ধতির প্রয়োজন হয়। ২০০৩ সালের ডিসেম্বর থেকে বিএসএমএমইউয়ে ইনফার্টিলিটি বিভাগ চালু হয়। তবে ২০১৯ সাল হতে অধ্যাপক ডা. জেসমিন বানুর তত্ত্বাবধানে টেস্টটিউব বেবির আইভিএফ পদ্ধতি পুরোদমে চালু হয়। করোনাকালীন সময়ে এই সেবা কিছুটা স্থগিত থাকে।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, বর্তমান ভিসি অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ দায়িত্বগ্রহণের পরপর ২০২২ সালে পুনরায় আইভিএফ পদ্ধতি চালুর জন্য ব্যাপক উদ্যোগ নেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের রিপ্রোডাক্টিভ এন্ডোক্রাইন এন্ড ইনফার্টিলিটি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. জেসমিন বানুর নেতৃত্বে বন্ধ্যাত্বের সর্বাধুনিক চিকিৎসা স্টেম সেল থেরাপি, পিআরপি থেরাপী, রিকনস্ট্রাকটিভ সার্জারি, এআরটি, আইইউআই, আইভিএফ সেবা প্রদান করা হচ্ছে।