আর্কাইভ থেকে বাংলাদেশ

পেশায় দিনমজুর হাসান নেশায় সাংবাদিক

পেশায় দিনমজুর হাসান নেশায় সাংবাদিক

কেউ চেনেন দিনমজুর হিসেবে আবার কেউবা বলেন স্বভাবকবি। কিন্তু এ সব পরিচিতির বাইরেও পটুয়াখালির বাসিন্দা হাসান পারভেজের আরও অনেক পরিচয় আছে। তিনি একাধারে সংবাদপত্রের সাংবাদিক, সম্পাদক ও প্রকাশক। পটুয়াখালির কলাপাড়া উপজেলায় আন্ধারমানিক নদীর তীরের ছোট্ট গ্রাম পশ্চিম সোনাতলা। আঁধারে মানিক হয়ে হাসান প্রকাশ করে চলেছেন ‘আন্ধারমানিক’ পত্রিকার একের পর এক সংখ্যা।

জন্ম মুহূর্ত থেকে সঙ্গী তার দারিদ্র্য। এসএসসি পরীক্ষায় বসার কথা ছিল ১৯৯৬ সালে। অর্থাভাবে দেয়া হয়নি পরীক্ষা। শেষ পর্যন্ত ২০১৫ সালে পারভেজ আবার বসেন পরীক্ষায়, উত্তীর্ণ হন সসম্মানে। স্কুল পেরিয়ে কলাপাড়া সরকারি কলেজে উচ্চ শিক্ষার জন্য এগিয়েছেন তিনি। সঙ্গে চলছে পত্রিকার কাজও।

দারিদ্র্যের সঙ্গে আরও একটি বিষয় শৈশব থেকেই সঙ্গী তার— লেখালিখির নেশা। হাসানের কথায়, কলমই তার প্রাণের সখা। তাই তাকে কেউ কাজে রাখেন না । কিন্তু তাতে একদিক থেকে সুবিধাই হয়েছে হাসানের। স্বাধীন ভাবে কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন তিনি। স্বাধীনভাবে কাজ করবেন বলেই বেছে নিয়েছেন দিনমজুরি। মাটি কাটা-ইট ভাটা দিন পিছু ছাড়েনি পারভেজের। চেষ্টাও করেননি সে সব ফেলে আসার। গণমাধ্যমকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে পারভেজ বলেন, তার পত্রিকায় শ্রমজীবী মানুষের সফলতার গল্প থাকে।

প্রত্যন্ত গ্রামে যাদের কথা কেউ শোনে না, হাসান কান পেতে শোনেন তাদের কথা লেখেন, তার পত্রিকায়। একদিন সেভাবেই তিনি লিখেছিলেন, ক্লাস থ্রিয়ের রুবিনার কথা। রুবিনার মানসিক প্রতিবন্ধী মাকে শিকল দিয়ে বেঁধে বৃদ্ধা ‘নানি’ যেতেন খাবার খুঁজতে। পাহারায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকত ছোট্ট রুবিনা।

জসীমউদ্দীনের ‘আসমানী’ কবিতা অবলম্বনে হাসান আন্ধারমানিক পত্রিকায় লেখেন, ‘রুবিনাকে দেখতে যদি তোমরা সবে চাও, তৈয়বআলীর ছোট্ট বাড়ি হোসেনপুরে যাও’। ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে যায় হাসানের এ কবিতা। ছড়িয়ে পড়ে তার নাম। রুবিনারও ভাগ্য ফেরে। গণমাধ্যমে তার কষ্টের কথা ছড়িয়ে পড়তেই মেলে আর্থিক সহায়তা। এভাবেই একের পর এক মানুষের ভাগ্য বদলে চলেছেন পারভেজ। তারই মতো আরও জনা পনেরো ‘সাংবাদিক’ জুটে গেছে সঙ্গে । দৈনন্দিন ইটভাটা, ধান তোলা কিংবা মাছ ধরার ফাঁকে ফাঁকে তারা ছুটে যান প্রান্তিক মানুষের কাছে। সংগ্রহ করেন তাদের কথা। তারপর পুরো পত্রিকাটি লেখা হয় হাতে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা গিয়েছে, প্রতি মাসে একটি করে সংখ্যা বার হয় পত্রিকাটির। প্রতি মাসে এক বার করে কথা বলে ‘আন্ধারমানিক’ ।

মানুষের কথা বলতে বলতে নিজেকে নিয়ে ভাবতে ইচ্ছে করে না? যশ কি সত্যিই তাকে টানে না তাকে? এমন প্রশ্নে হাসান জানান, নিজের কথা নিজের পত্রিকায় লিখতে লজ্জা লাগে তার। স্ত্রী ও দুই মেয়েকে নিয়ে যে এক কামরার ঘরে হাসান থাকেন, সেটিও তার নিজের নয়। যেদিন মালিক উচ্ছেদ করে দেবেন, সেদিনই চলে যেতে হবে অন্য কোথাও। তবু সরকারের ঘর দিতে চাওয়ার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে হাসান জানিয়েছেন, তার তো তবু মাথার উপর ছাদ আছে। বরং তাদের ঘর দেয়া হোক যাদের সেটুকুও নেই। আত্মপ্রচারের লোভ নেই, থাকার মধ্যে আছে একটি স্বপ্ন। তিনি থাকুন বা না থাকুন তার পত্রিকা যেন সেইসব মানুষের মুখপত্র হয়ে থাকে যাদের মুখ চাপা পরে গিয়েছে খিদে আর দারিদ্র্যের মলিনতায়।

অনন্যা চৈতী

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন পেশায় | দিনমজুর | হাসান | নেশায় | সাংবাদিক