অন্যান্য

ডলার এনডোর্সমেন্ট সম্পর্কে কিছু তথ্য

ডলার এনডোর্সমেন্ট সম্পর্কে কিছু তথ্য
উচ্চশিক্ষা, বিদেশ ভ্রমণসহ আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ের আর্থিক কর্মকাণ্ডগুলো পরিচালনার জন্য প্রয়োজন পড়ে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবহারের। আর এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো ডলার এনডোর্সমেন্ট। বিশ্ব অর্থনীতি ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের একটি পাওয়ার হাউস হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারকে বিশ্বব্যাপী সাধারণ বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। কোনো একটি দেশের পণ্য বা সেবা ক্রয় করার সময় এই মুদ্রার এনডোর্সমেন্ট সংশ্লিষ্ট দেশটির মুদ্রা ব্যবহারে বৈধতা দেয়। চলুন জেনে নেয়া যাক এই ডলার এনডোর্সমেন্ট কী এবং কীভাবে করবেন সে বিষয়ে-

ডলার এনডোর্সমেন্ট কী

এই আর্থিক কার্যক্রমটির মানে হলো দেশের অভ্যন্তরে বা বাইরে যে কোনো লেনদেনে ডলার ব্যবহারের অনুমোদন। এর মাধ্যমে বিদেশি পণ্য বা সেবা নেয়ার জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ ডলার ব্যবহারের বৈধতা পাওয়া যায়। এই ডলারগুলো পরে সরাসরি কিংবা প্রয়োজনের সাপেক্ষে, বিশেষত বিদেশ ভ্রমণের সময় সেই দেশের মুদ্রায় পরিবর্তন করে নেয়া যায়। এটি শুধু বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত একটি প্রক্রিয়াই নয়, ডলার এনডোর্সমেন্ট ছাড়া ডলার সংক্রান্ত কোনো লেনদেনে জড়িত হওয়া বেআইনি।

ডলার এনডোর্সমেন্টের সুবিধা

যে কাজগুলোর সঙ্গে আন্তর্জাতিক লেনদেন সম্পৃক্ত, এমন প্রতিটি কাজেই প্রয়োজন হয় ডলার খরচ করার। আর এই প্রয়োজনীয় খরচ সামাল দিতেই এনডোর্স করে নিতে হয় সেই পরিমাণ ডলারটি। যেমন বিদেশে ভ্রমণ, উচ্চশিক্ষা ও চিকিৎসার জন্য সেই দেশে যাওয়ার সময় উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ডলার সঙ্গে নিতে হয়। চাকরি ও ব্যবসার কাজে যে দেশেই যাওয়া হোক না কেন, প্রাথমিক ব্যয়ের খাতগুলো নিরবচ্ছিন্ন রাখতে দরকার হয় ডলারের। ফলে অবধারিত হয়ে পড়ে সেই সংখ্যক ডলার সঙ্গে রাখার অনুমতি নেয়া। এ ছাড়া দেশের ভেতরে থেকেও বৈদেশিক কাজগুলো আঞ্জাম দিতে হলে ডলারের কোনো বিকল্প নেই। বিদেশি স্টক মার্কেটে বিনিয়োগ, বিদেশি মার্কেট থেকে কেনাকাটা, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে দেশে ফিরে ডলারের বাংলাদেশি টাকায় রূপান্তরের জন্যও ডলার অনুমোদনের গুরুত্ব অপরিসীম। দেশের ভেতরে যারা ইউটিউব ও ফেসবুকের মতো সামাজিক মাধ্যমগুলোসহ ইন্টারনেটে বিজ্ঞাপন দেন, তাদের প্রায় ক্ষেত্রে ডলারের বৈধতা নিশ্চিত করে নিতে হয়। এ ছাড়া আমদানি বা রপ্তানি ব্যবসার কাজগুলো বৈধভাবে কার্যকর করার জন্যও দরকার হয় ডলার আদান-প্রদানের অনুমতি।

ডলার এনডোর্সমেন্টের উপায়

আইনগতভাবে ডলার ব্যবহারের ক্ষমতা অর্জন করতে হলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে এর অনুমোদন নিতে হয় পাসপোর্টে সিলের মাধ্যমে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ইস্যু করা হয়ে থাকে সনদপত্র, যেখানে উল্লেখ থাকে নির্দিষ্ট সংখ্যক ডলারের অংক। শুধু তাই নয়, এখানে একটি বড় বিষয় হচ্ছে অনুমোদনটি কে দিচ্ছে সেটা। অর্থাৎ ডলারগুলো কোথা থেকে কেনা হচ্ছে ও ডলার বিক্রির জন্য তাদের যথাযথ অনুমোদন আছে কি না সেটি গুরুত্বপূর্ণ। দেশের ভেতরে শুধু বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদিত ব্যাংক, মানি এক্সচেঞ্জার ও ডিলাররা আইনগতভাবে ডলার কেনা-বেচা করতে পারে। এ ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ডলারের লেনদেনে জড়ানো বেআইনি। এবার এই এনডোর্সমেন্ট পদ্ধতিটির আরও খুঁটিনাটি জেনে নেয়া যাক।

ব্যাংক থেকে ডলার এনডোর্স করার প্রক্রিয়া

দেশের যে কোনো সরকারি বা বেসরকারি ব্যাংক পাসপোর্ট বইয়ের শেষের দিকে এনডোর্সমেন্ট পাতায় সিল দিয়ে নির্দিষ্ট পরিমাণ ডলারের পরিমাণ লিখে দেয়। এটিই হলো অনুমোদনকৃত ডলারের পরিমাণ, যেটি এনডোর্সকারি কাগুজে ডলার উঠিয়ে কিংবা অনলাইনে ব্যবহার করতে পারেন। এই ডলারপ্রাপ্তির জন্য এনডোর্সকারী সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে সমপরিমাণ বাংলাদেশি টাকা দেন। এই পরিমাণটি ঠিক হয় বর্তমানে ডলার থেকে বাংলাদেশি টাকায় বিনিময় হার যত চলছে সে অনুসারে। এই হারটি অবশ্য একটি নির্দিষ্ট রেঞ্জের মধ্যে বিভিন্ন ব্যাংকে কম-বেশি হয়ে থাকে।

সোনালী ব্যাংক ও অন্যান্য ব্যাংকে ডলার এনডোর্সমেন্টের ভিন্নতা

বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর মধ্যে শুধু সোনালী ব্যাংকে ডলার এনডোর্সের জন্য সেখানে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থাকার বা নতুন করে করার প্রয়োজন পড়ে না। শুধু পাসপোর্ট নিয়ে গেলেই কাজ হয়ে যায়। ব্যাংক কর্মকর্তা ওই দিনের ডলার রেট অনুসারে টাকা হিসাব করে সার্ভিস চার্জের বিনিময়ে নির্দিষ্ট পরিমাণ ডলারের অংক উল্লেখ করে পাসপোর্টে সিল মেরে দেন। অন্যদিকে বাকি সব ব্যাংকে এই কার্যকলাপের জন্য অ্যাকাউন্ট থাকতে হয়। এ ছাড়া বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে সাধারণত লোকাল শাখাগুলোতে এনডোর্স করা হয় না। এই সুবিধা দিয়ে থাকে শুধু এডি বা অনুমোদিত ডিলার, শাখা বা ফরেইন এক্সচেঞ্জগুলো। বিভাগীয় শহর ও কিছু বাণিজ্যিক এলাকা ছাড়া কোথাও বেসরকারি ব্যাংকগুলোর এডি শাখা নেই। লোকাল শাখাতে এনডোর্স করতেই হলে সেখানে একটা ফরওয়ার্ডিং লেটার দিয়ে ডলার পরিবর্তনের চেষ্টা করা যেতে পারে। এ ছাড়াও বেসরকারি ব্যাংকগুলোর প্রত্যেকটিতে ডলার এনডোর্সিংয়ের শর্তগুলোতে কিছু ভিন্নতা থাকে। তাই চূড়ান্তভাবে এনডোর্সমেন্টের আগে অবশ্যই সেগুলো সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে নেওয়া জরুরি।

ডুয়েল কারেন্সি কার্ডের বিপরীতে ডলার এনডোর্স

গত কয়েক বছর ধরেই বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে বিভিন্ন ব্যাংকের ডুয়েল কারেন্সি কার্ড সেবাগুলো। অনেকেই সরাসরি ডলার না তুলে এই আন্তর্জাতিক ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ডের বিপরীতে বৈধভাবে ডলার জমা করে নিচ্ছেন। এই সেবার মাধ্যমে দেশ থেকে কার্ডে ডলার জমা করে বিদেশে নিয়ে গিয়ে সেখানে খরচ করা যায়। এমনকি প্রয়োজনে অন্যান্য বৈদেশিক মুদ্রাতেও পরিবর্তন করে নেওয়া যায়। তাছাড়া অনলাইন কেনাকাটার সুবিধা তো থাকছেই। এমনকি দেশের ভেতরে থেকেও বিশ্বের বিখ্যাত সব ই-কমার্স মার্কেটগুলো থেকে কোনো ঝামেলা ছাড়াই নানা সেবা ও পণ্য কেনা যায়। বিদেশে চিকিৎসা ক্ষেত্রে খরচ করার জন্যও দেশি ব্যাংকের এই কার্ডগুলো বেশ উপকারী।

এলসির মাধ্যমে ডলার এনডোর্সমেন্ট

এলসি বা লেটার অফ ক্রেডিট মূলত যারা আমদানি বা রপ্তানি ব্যবসার সঙ্গে জড়িতে তাদের জন্য দরকারি। এই ক্ষেত্রে ডলার এনডোর্সের জন্য এলসি করা হয় ব্যাংকের মাধ্যমে। এটি মূলত সেই আমদানি বা রপ্তানি কাজের জন্য ডলার বিনিময়ে বৈধতা দানকারী সনদপত্র। মানি এক্সচেঞ্জ থেকে ডলার কেনার নিয়ম ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানগুলো অপেক্ষা মানি এক্সচেঞ্জারগুলোর ডলার এনডোর্সিংয়ের প্রক্রিয়া তুলনামূলকভাবে সহজ। যে কোনো বৈধ পাসপোর্টধারী ওই দিনের রেট অনুযায়ী সমপরিমাণ টাকা দিয়ে ডলার তুলে নিতে পারবেন এই এক্সচেঞ্জারগুলো থেকে। এক্সচেঞ্জ ফি দেওয়া ছাড়া এখানে ব্যাংকের মতো ডকুমেন্টেশনের বাড়তি বিড়ম্বনা নেই। তবে এই এনডোর্সমেন্ট ভিসা আবেদনের ক্ষেত্রে ব্যবহারযোগ্য নয়। ভিসার জন্য শুধু ব্যাংকের ডলার এনডোর্সমেন্ট গ্রহণযোগ্য। অনেকেই অল্প কিছু টাকা বাঁচাতে গিয়ে এনডোর্স ছাড়া ডলার নিয়ে ইমিগ্রেশনে গিয়ে বিপদে পড়েন। কারণ প্রায়ই ক্ষেত্রে সেখানে ডলারের পাসপোর্ট এনডোর্সমেন্টটা চেক করা হয়। তাই সার্বিক দিক থেকে ঝক্কি-ঝামেলা মুক্ত থাকার জন্য ডলার পাসপোর্টে এনডোর্স করে নেয়া উচিত।

কত ডলার এনডোর্স করা যায়

ডলার এনডোর্সের পরিমাণ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সুষ্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি বিদেশ গমনকালে এক বছরে সর্বোচ্চ ১২ হাজার ডলার বা সমমানের বৈদেশিক মুদ্রা এনডোর্স করতে পারবেন। যারা ১২ বছরের নিচে রয়েছেন তারা এর অর্ধেক অর্থাৎ ৬ হাজার ডলার ব্যবহারের অনুমোদন নিতে পারবেন। চিকিৎসার জন্য সর্বোচ্চ ১০ হাজার ডলারের অনুমোদন নেয়া যাবে, তবে এর জন্য অবশ্যই উপযুক্ত কাগজপত্র দেখাতে হবে। এর চেয়ে বেশি প্রয়োজন হলে যথাযথ কারণ ও প্রমাণসহ যোগাযোগ করতে হবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের সঙ্গে।

ডলার এনডোর্সের মেয়াদ কত দিন

বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মানুসারে, ডুয়েল কারেন্সি আন্তর্জাতিক ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ডের বিপরীতে পাসপোর্টের মেয়াদ যতদিন ততদিন থাকবে এনডোর্সমেন্টের মেয়াদ। তবে এক্ষেত্রে কিছু শর্ত রয়েছে- খরচের পরিমাণ এনডোর্সকৃত ডলারের সর্বোচ্চ লিমিট অর্থাৎ ১২ হাজার অতিক্রম করতে পারবে না। সম্পূরক কার্ডধারীরা বিদেশ ভ্রমণকালে তাদের ভ্রমণ কোটার আওতাতেই এই সুবিধা পাবেন। তবে ভ্রমণ কোটার যে অংশটুকু বাকি থাকবে, তা ব্যবহারের জন্য পরের বছরে স্থানান্তর করা যাবে না। এই সুবিধা প্রবাসী বাংলাদেশি বা শিক্ষার্থীদের জন্য প্রযোজ্য নয়। বাংলাদেশিদের জন্য যাবতীয় আন্তর্জাতিক লেনদেন সহজতর করার জন্যই এই ডলার এনডোর্সমেন্ট প্রক্রিয়া। অপেক্ষাকৃত সীমিত ডকুমেন্টেশনের আনুষ্ঠানিকতা থাকায় সোনালী ব্যাংক ও মানি এক্সচেঞ্জারগুলো এক্ষেত্রে সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছে। এরপরেও প্রযোজ্য শর্তগুলো সতর্কতার সঙ্গে মেনে অগ্রসর হলে বেসরকারি ব্যাংকগুলো থেকেও পাওয়া যাবে কাঙ্ক্ষিত সেবা।

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন ডলার | এনডোর্সমেন্ট | সম্পর্কে | কিছু | তথ্য