ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজায় যুদ্ধবিরতি বিষয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপিত প্রস্তাবে আবারো ভেটো দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। স্থানীয় সময় মঙ্গলবার(২০ ফেব্রুয়ারি) জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে গাজায় ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে স্থায়ী যুদ্ধবিরতির জন্য একটি খসড়া প্রস্তাব ওঠায় আলজেরিয়া। নিরাপত্তা পরিষদের ১৫ সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে রাশিয়া, চীন, ফ্রান্সসহ ১৩টি দেশ ওই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়। স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্র যুক্তরাজ্য ভোটদানে বিরত থাকে। তবে যুক্তরাষ্ট্র ভেটো দেওয়ায় ওই প্রস্তাব আর আলোর মুখ দেখতে পেলো না। ইসরায়েল-হামাস স্থায়ী যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে এনিয়ে তৃতীয় বারের মতো ভেটো দিলো যুক্তরাষ্ট্র।
ব্রিটিশ গণমাধ্যম রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে স্থায়ী যুদ্ধবিরতির পক্ষে নয় যুক্তরাষ্ট্র। দেশটি শুধুমাত্র বন্দি বিনিময়ের জন্য সাময়িক যুদ্ধবিরতির পক্ষে।
এদিকে, এতদিন বিরোধীতা করে আসলেও এবার ইসরায়েল-হামাসের মধ্যে একটি সাময়িক যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব নিরাপত্তা পরিষদে উঠিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ওই প্রস্তাবটি এখনও খসড়া পর্যায়ে রয়েছে। ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, গাজা উপত্যকায় শিগগিরই অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি, হামাসের কব্জায় থাকা জিম্মিদের মুক্তি এবং উপত্যকায় মানবিক সহায়তা ও ত্রাণসামগ্রী পৌঁছানোর ক্ষেত্রে যাবতীয় বাধা-প্রতিবন্ধকতা তুলে নেওয়া— এই ৩টি বিষয় গুরুত্ব দিয়ে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে প্রস্তাবে। যুক্তরাষ্ট্রের এই নতুন খসড়া প্রস্তাব নিয়ে ইসরায়েলের কোনো মন্ত্রী বা কর্মকর্তা মন্তব্য করতে রাজি হননি।
গত নভেম্বরে গাজায় যুদ্ধবিরতির প্রথম প্রস্তাবটি নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে তোলে রাশিয়া। তবে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের আপত্তির কারণে প্রস্তাবটি পাস হয়নি। পরবর্তীতে আরও দু’দফায়
নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব ওঠে। প্রতিবারেই যুক্তরাষ্ট্র ভেটো দেয়। মঙ্গলবারও আলজেরিয়ার উত্থাপিত নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবে ভেটো দিয়েছে।
এর আগে, গত নভেম্বরে অস্থায়ী মানবিক বিরতিতে সম্মত হয়েছিল ইসরায়েলের অন্যতম মিত্রদেশ যুক্তরাষ্ট্র। ওইসময় নিজেদের কব্জায় থাকা ২ শতাধিক জিম্মির মধ্যে অর্ধেক জিম্মিকে ছেড়ে দিয়েছিল ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস। বিনিময়ে ইসরায়েলের বিভিন্ন কারগারে বন্দি দেড় শতাধিক ফিলিস্তিনিকে মুক্তি দেয় ইসরায়েল।
গত ২৫ নভেম্বর শুরু হয়ে ১ ডিসেম্বর শেষ হয় ওই যুদ্ধবিরতি। পরে আবারও ইসরায়েলি বাহিনী ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয় যা এখনও চলছে।
যেকারণে সাময়িক যুদ্ধবিরতি চাইছে যুক্তরাষ্ট্র
যুদ্ধের শুরু থেকে ইসরায়েলকে সমর্থন জানিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। পাশাপাশি গাজায় বেসামরিক নাগরিকদের নিহতের হার কমানো, অভিযানকে আরও নিখুঁতভাবে পরিচালনা করা, উপত্যকায় ত্রাণ সরবরাহ নিয়মিত করার পরামর্শও দিচ্ছে। তবে ইসরায়েলের যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভা এসব পরামর্শ আমলে নিচ্ছে না। বরং সম্প্রতি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, তারা দ্বিরাষ্ট্র সমাধানে বিশ্বাসী নয়।
চলমান যুদ্ধের মধ্যেই গত ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে একাধিকবার গাজায় যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব উঠেছে নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে; সর্বশেষ প্রস্তাবটি উঠেছিল গত সপ্তাহের মঙ্গলবার।তবে যুক্তরাষ্ট্রের আপত্তির জন্য কোনো প্রস্তাবই আলোর মুখ দেখেনি।
তবে এক সপ্তাহ যেতে না যেতেই ভোল পাল্টে গাজায় যুদ্ধবিরতির পক্ষে অবস্থান নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ইসরায়েল এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়েছে তারা খুব শিগগির রাফায় স্থল অভিযান চালাবে।
টাইমস অব ইসরায়েলের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রমজান শুরুর আগে বন্দী ইসরাইলি জিম্মিদের মুক্তি না দিলে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী গাজার নিরাপত্তার শেষ আশ্রয়স্থল রাফায় স্থল অভিযান শুরু করবে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ইসরাইলের যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভার সদস্য বেনি গান্তজ বলেন, ‘ রমজানের মধ্যে জিম্মি ব্যক্তিরা যদি নিজ বাসায় (ইসরাইল) না ফিরতে পারেন, তাহলে রাফাসহ গাজার সব জায়গায় লড়াই চলবে। হামাসের সামনে একটি পথ খোলা আছে। তারা আত্মসমর্পণ করতে পারে; জিম্মিদের মুক্তি দিতে পারে। তাহলে গাজার বেসামরিক মানুষ রমজানে রোজা পালন করতে পারবেন।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মতে, সাবেক অবস্থান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের এভাবে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে যাওয়ার প্রধান কারণ গাজার রাফাহ শহরে ইসরায়েলি বাহিনীর অভিযানের পরিকল্পনা।
রাফায় ব্যাপক সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসরায়েল। শহরটি মিসরের সীমান্তবর্তী হওয়ায় ইসরায়েলি বাহিনীর অভিযানে মিসরের ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাছাড়া মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে মিসর যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ঘনিষ্ট মিত্রদের মধ্যে অন্যতম।
প্রসঙ্গত, গত ৭ অক্টোবর হামাসের যোদ্ধারা গাজার উত্তরাঞ্চলীয় ইরেজ সীমান্তে হামলা চালিয়ে ১ হাজার ২০০ জন মানুষকে হত্যার পাশাপাশি ২৪০ জন ইসরায়েলি ও বিদেশি নাগরিককে ধরে নিয়ে যায়। এর প্রতিশোধ নিতে গাজায় অভিযান শুরু করে ইসরায়েলি বাহিনী।
তাদের চারমাসের বেশি সময় ধরে চলমান অভিযানের শুরু থেকে এ পর্যন্ত গাজায় ২৯ হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও ৭০ হাজার। আর বাড়িঘর হারিয়ে নিজ দেশেই বাস্তচ্যুত লাখো ফিলিস্তিনি।