মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে মেয়েদের অন্যতম শীর্ষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ ঘিরে নানা আলোচনা চলছে। প্রতিষ্ঠানটির আজিমপুর শাখার ওই শিক্ষককে গ্রেফতার ও রিমান্ডে নেওয়ার পদক্ষেপকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই স্বাগত জানিয়েছেন।
নারী শিক্ষার্থীদের সুরক্ষায় সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধের লক্ষ্যে কমিটি গঠনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এর খুব একটা অস্তিত্ব নেই বলে মানবাধিকার কর্মী ও শিক্ষাবিদরা জানিয়েছেন। তারা বলছ্নে, কতিপয় প্রতিষ্ঠানে কমিটি থাকলেও সেগুলোও খুব একটা কাজ করে না। তবে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর বলছে অন্য কথা। অধিদপ্তরের দাবি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ বিষয়ক কমিটি রয়েছে এবং সেগুলো নিয়মিত তদারকিও করা হয়।
রাজধানীতে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের বিভিন্ন শাখায় ঘটেছে একাধিক যৌন হয়রানির ঘটনা। সেই পরিমল জয়ধর থেকে শুরু করে বর্তমান মুরাদ হোসেন সরকার। এর মাঝে বসুন্ধরা শাখার ইংরেজি শিক্ষক আবু সুফিয়ানের কেলেঙ্কারিও যথেষ্ট সমলোচনার ঝড় তোলে। সম্প্রতি মুরাদ হোসেন সরকারের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ তুলেছেন প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীরা। অভিযুক্ত শিক্ষকের বরখাস্ত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে বিদ্যালয়ের সামনে বিক্ষোভও করেছেন তারা।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কমিটি বাধ্যতামূলক?
বাংলাদেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এবং কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি বন্ধে ২০০৯ সালে হাইকোর্টের দেওয়া নির্দেশনা রয়েছে। এতে সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন প্রতিরোধ কমিটি গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
২০০৯ সালের ১৪ মে আদালত কর্মস্থল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন প্রতিরোধে নির্দেশনা দেন। এতে বলা হয়, প্রত্যেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মস্থলে যৌন নিপীড়নবিরোধী পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করতে হবে। এর প্রধান হবেন একজন নারী। ওই কমিটিতে একাধিক নারী সদস্য থাকবেন। এর মেয়াদ হবে দুই বছর। প্রতিবছর কমিটি দুবার সভা করবে। দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মস্থলে অভিযোগ কেন্দ্র থাকবে। পাঁচ সদস্যের কমিটি ওই কেন্দ্র পরিচালনা করবে। কমিটি যৌন হয়রানির কোনো অভিযোগ পেলে তদন্ত ও অনুসন্ধান সাপেক্ষে অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পুলিশকে বলবে। এরপর দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী অপরাধের ধরন ও মাত্রা বুঝে বিচার বিভাগ যথাযথ ব্যবস্থা নেবে।
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর-মাউশি যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি গঠনে সর্বশেষ ২০২২ সালের ১০ ডিসেম্বর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশনা দিয়েছে।অধিদফতর বলছে, সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি বিষয়ে অভিযোগ গ্রহণ, তদন্ত পরিচালনা এবং সুপারিশ করার জন্য কমপক্ষে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করতে হবে। যার সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য হবেন নারী। সম্ভব হলে কমিটির প্রধান হবেন নারী। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বাইরে অন্য প্রতিষ্ঠান থেকে কমিটির দুজন সদস্য নিতে হবে। অভিযোগ গ্রহণকারী কমিটি ৩০ দিনের মধ্যে সুপারিশসহ তদন্ত প্রতিবেদন কর্তৃপক্ষের কাছে দাখিল করবে। প্রতিষ্ঠানের সামনে যৌন হয়রানি প্রতিরোধসংক্রান্ত একটি অভিযোগ বক্স থাকবে।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের কলেজ ও প্রশাসন শাখার পরিচালক প্রফেসর মো. শাহেদুল খবির চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ সম্পর্কিত একটি কমিটি থাকার কথা রয়েছে। এই কমিটি স্কুল কমিটি থেকে ভিন্ন।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এই কমিটি আছে কি না সেটি মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা সম্পর্কে তিনি বলেন, মাউশির মাঠ পর্যায়ের কিছু কর্মী রয়েছে যাদের কাজের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এ ধরনের কমিটি আছে কি না এবং সেগুলো সঠিকভাবে কাজ করছে কি না, তা তদারকি করা। তারা এ সম্পর্কিত প্রতিবেদন মাউশির কাছে জমা দেয় বলে জানান তিনি।
তবে মানবাধিকার কর্মী ও শিক্ষাবিদরা অবশ্য বলছেন যে, মাঠ পর্যায়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে কী ধরনের ব্যবস্থা আছে এবং সেগুলো কাজ করছে কি না তার আসলে কোনও নজরদারি নেই।
কমিটি আছে তা জানে না শিক্ষার্থীরা
গত ০৭ ফেব্রুয়ারি ভিকারুননিসা স্কুলের আজিমপুর শাখার শিক্ষক মুরাদ হোসেনের বিরুদ্ধে অধ্যক্ষের কাছে যৌন হয়রানি ও নিপীড়নের লিখিত অভিযোগ করেন একাধিক অভিভাবক। পর দিন অধ্যক্ষ কেকা রায় চৌধুরী তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে দেন।
এই কমিটি প্রাথমিক তদন্তে ঘটনার সত্যতা খুঁজে পাওয়ার পর ওই শিক্ষককে চাকরিচ্যুত না করে আজিমপুর শাখা থেকে প্রত্যাহার করে ঢাকার বেইলি রোডের অধ্যক্ষের কার্যালয়ে সংযুক্ত করা হয়।পাশাপাশি অধিকতর তদন্তের জন্য ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার অফিস থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়।
এবিষয়ে বায়ান্ন টিভিকে প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ কেকা রায় চৌধুরী বলেন, ‘মুরাদ হোসেনকে সাময়িক বরখাস্তের পাশাপাশি পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয় থেকে তিন সদস্যের উচ্চতর তদন্ত কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আগামী ১০ কর্মদিবসের মধ্যে তারা প্রতিবেদন জমা দিবেন। এরপরই গভর্নিং বডি তার ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে ।’
শিক্ষাবিদ রাশেদা কে চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা জানেই না যে, এ ধরনের কোনও কমিটি স্কুল বা কলেজে রয়েছে। বেশির ভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, এমনকি মহানগরীগুলোতেও বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানে এই কমিটি বা সেল গঠন করা হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘শহরে যদিও বা কিছু জানে, গ্রামে-গঞ্জে এটা জানেই না। আর জানলেও অভিযোগ করতে সাহস করে না। আর অভিভাবক লেভেল থেকে অনাস্থা আছে যে করে কোনও লাভ হবে না, মাঝখান থেকে হেনস্থা হবে।’
যৌণ হয়রানি বন্ধ না হওয়ার কারণ
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি বন্ধ না হওয়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে বলে মনে করেন শিক্ষাবিদ রাশেদা কে চৌধুরী। এর মধ্যে প্রথম, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যৌন হয়রানি হলেও সে সম্পর্কে কোনও অভিযোগ করা হয় না।দ্বিতীয়ত, সামাজিক কারণে বা হেনস্থা হওয়া বা মানসম্মানের ভয়ে অনেকে অভিযোগ করেন না।
আর তৃতীয়ত, বিচার না পাওয়ার আশঙ্কায় অনেক অভিভাবক আর অভিযোগ করতে এগিয়ে আসেন না। আইনের দ্বারস্থ হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিচার হয়না, অনেক ক্ষেত্রে অভিযোগই নেওয়া হয়না। এ কারণে অভিভাবকের মধ্যে অনাস্থা রয়ে গেছে।
যৌন হয়রানি বন্ধে যা করতে হবে
রাশেদা কে চৌধুরীর মতে আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ি প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সেল বা কমিটি করতে হবে। যাতে শিক্ষার্থীরা এ ধরনের ঘটনার শিকার হলে অভিযোগ দায়ের করতে পারে।
তিনি বলেন, ‘ এই না হওয়ার পেছনে মূল দায় হচ্ছে ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান এবং ম্যানেজিং কমিটি ও গভর্নিং বা পরিচালনা কমিটির।একজন শিক্ষার্থী যে সাহস করে অভিযোগটা করবে, সেই জায়গাটাই যদি না থাকে তাহলে সে যাবে কেন?’
তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠানগুলো যদি নিয়মতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে থেকে যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করত তাহলে এ ধরনের ঘটনা ঘটতো না। সেটা হয় না বলেই এসব ঘটনা সামনে আসে।
শিক্ষাবিদ ড. মঞ্জুর আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেন, স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদিচ্ছার অভাব, স্কুল কর্তৃপক্ষের মনোযোগের অভাবের কারণে এ ধরনের ঘটনা বন্ধ করা কঠিন হয়। এছাড়া অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষকদের সংশ্লিষ্টতার কারণেও অনেক ঘটনা প্রতিরোধ করা সম্ভব হয় না বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক ফারুক ফয়সাল বলেন, বাংলাদেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন নির্যাতন প্রতিরোধী কমিটি থাকার কথা। তবে এই কমিটি আদৌ আছে কি না তা তদারকির কোনও ব্যবস্থা নেই। একই সাথে কেউ এ ধরণের কমিটি না করলে তার কোনও শাস্তিও হচ্ছে না। ফলে দিন দিন এ ধরনের অপরাধ বেড়ে যাচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘সরকার ও প্রশাসনের উচিত এই বিষয়টি পর্যাপ্ত গুরুত্ব দিয়ে এটি প্রতিরোধের একটা ব্যবস্থা নেওয়া।’
শিক্ষার্থীদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর উপর গুরুত্ব দিয়ে রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, কতগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ ধরনের কমিটি রয়েছে তার একটি তালিকা থাকতে হবে। যে সব প্রতিষ্ঠানে কোনও কমিটি নেই তাদেরকে দায়বদ্ধ করতে হবে।
তিনি বলেন, ‘এসব ব্যাপারে সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় যৌথভাবে কাজ করতে পারে। তারা তদারকি করতে পারে যে কমিটিগুলো গঠন করা হয়েছে কি না।
শিক্ষাবিদ ড. মঞ্জুর আহমেদ বলেন, প্রতিটি স্কুলে অভিভাবক, স্থানীয় শিক্ষা বিষয়ক বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধিদের নিয়ে এই সমস্যাটা আলোচনা করতে হবে এবং ঠিক করতে হবে যে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া যায়। এ ব্যাপারে পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তা নেওয়া যেতে পারে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।