জাতীয়

যুক্তরাজ্যে টিকটকে ট্রলের শিকার বাংলাদেশি নারীরা, বাড়ছে আত্মহত্যার প্রবণতা

যুক্তরাজ্যে টিকটকে ট্রলের শিকার বাংলাদেশি নারীরা, বাড়ছে আত্মহত্যার প্রবণতা
বাংলাদেশিদের কাছে ফেসবুকের চাইতে সামাজিক যোগাযোগের অন্যতম জনপ্রিয় মাধ্যম টিকটক।  তরুণ প্রজন্মের কাছে শর্ট ভিডিও শেয়ারিং অ্যাপ্লিকেশন নামে পরিচিত এই অ্যাপটি ব্যবহার করে যেকোনো ভিডিও তৈরি করে তা শেয়ার দিলেই লাখো টিকটক ব্যবহারকারীদের কাছে পৌঁছে যায়। তবে যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সে বসবাসরত বাংলাদেশি নারীদের অনেকেই বলছেন, টিকটকে তাঁরা ট্রলের শিকার হয়েছেন এবং এখনও অনেকে হচ্ছেন। এসব ট্রলের কারণে তাঁদের জীবন রীতিমতো অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। এমনকি অনেকে আত্মহত্যার কথাও ভাবছেন। সবচেয়ে অবাক করার বিষয় হলো-এই ট্রল কিন্তু অন্য সম্প্রদায়ের কেউ করছে না। টিকটক ব্যবহারকারী বাংলাদেশি কমিউনিটির লোকজনই ট্রল করে বাংলাদেশি নারীর জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলছেন। ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা বিবিসির অনুসন্ধানী এক প্রতিবেদনে এ ভয়ানক তথ্য উঠে এসেছে।মঙ্গলবার (২ এপ্রিল) বিবিসিতে ওই প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়। যুক্তরাজ্যে বসবাসরত বাংলাদেশিদের মধ্যে টিকটক বেশ জনপ্রিয়। বিশেষ করে নারীদের মধ্যে।অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা ইস্যুতে কথা বলেন। তবে ভুক্তভোগীদের অনেকেই বলছেন, নারীরা অনলাইনে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলবেন, এটা নিজ সম্প্রদায়ের অনেকেই মানতে পারেন না। নারীদের এ মতামত প্রকাশ বাংলাদেশিদের অনেক পুরুষ পছন্দ করেন না। তারা নারীদের থামিয়ে দিতে চান। আর এ জন্যই ট্রলকে তারা বেছে নিচ্ছেন। প্রতিবেদনে বলা হয়, টিকটকের মাধ্যমে নারীদের নিপীড়ন ও হুমকি দেওয়া হচ্ছে। ভুক্তভোগীরা যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের পুলিশ এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করছেন। তবে ওই দেশ দুটির কাছ থেকে তেমন কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না। এ পরিপ্রেক্ষিতে অনেক ভুক্তভোগী নারী বলছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ ধরনের ট্রলিং, নিপীড়ন, হুমকির কারণে তাঁরা খুবই হতাশ। এসব বন্ধে কেউ কোনো উদ্যোগ না নেওয়ায়  তাঁদের অনেকের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা দিচ্ছে। বিবিসির ওই প্রতিবেদনে সুলতানা ছদ্মনামে যুক্তরাজ্যের ইয়র্কশায়ারে বসবাসরত ভুক্তভোগী এক নারী বলেন, নারীবিদ্বেষ ও তিক্ত হয়ে ওঠা সম্পর্কের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কথা বলার প্ল্যাটফর্ম হিসেবে তিনি টিকটককে বেছে নিয়েছিলেন। ২০২১ সালে তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্রলের শিকার হয়েছিলেন উল্লেখ করে সুলতানা জানান, ট্রলের শিকার হওয়া এক বন্ধুর হয়ে কথা বলার পর তাঁকেও লক্ষ্যবস্তু বানানো হয়। সুরতানা বলেন, ‘আমি কাজ করছিলাম। টিকটকে আমার কয়েকজন অনুসারী বার্তা পাঠান। জিজ্ঞেস করেন, আমাকে ট্রল করে প্রকাশ করা ভিডিওগুলো আমি দেখেছি কি না?’ সুলতানা আরও বলেন, ‘মানুষজন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্রল পোস্টগুলোয় আমাকে নিয়ে নানা মন্তব্য করছিল। হাসাহাসি করছিল।’ এই ট্রল একপর্যায়ে রীতিমতো নিপীড়নে পরিণত হয়। বছর দুয়েক চলেছিল। সুলতানা বলেন, ‘আমি মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে লড়াই করেছি। এ পরিস্থিতি সামাল দিতে থেরাপি নিয়েছি। ট্রলের ঘটনাগুলো আমার অসুস্থতা বাড়িয়ে দিয়েছে।’ সুলতানাসহ ভুক্তভোগী আরও কয়েকজন নারী জানান, এই ট্রলের পেছনে জড়িত আছেন হাসান সায়েদ নামের বাংলাদেশি এক ব্যক্তি। হাসান ফ্রান্সের প্যারিসে থাকেন।  টিকটকে হাসানের হাজার হাজার অনুসারী রয়েছে। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে ব্যক্তিগত ছবি ও তথ্য সংগ্রহ করেন হাসান। পরে সেসব ট্রল ভিডিওর ‘গ্রিন স্ক্রিনে’ জুড়ে দেন। এরপর হাসান টিকটকে লাইভে আসেন। ভুক্তভোগী নারীদের নিয়ে মজা করেন। এমনকি ধর্ষণ ও হত্যার হুমকিও দেন। ভুক্তভোগীদের আরেকজন মাসুমা থাকেন যুক্তরাজ্যের ওয়েলসে। চাকরির পাশাপাশি রান্নার নানা সামগ্রী বিক্রি করেন তিনি। এ জন্য টিকটকে লাইভ করেন। মাসুমা বলেন, ‘একদিন লাইভে ছিলাম। হাসান সায়েদ লাইভে যুক্ত হন। তাঁকে অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানানোর প্রস্তাব দেন। প্রত্যাখ্যান করলে আমাকে “ঝুলিয়ে দেওয়ার” হুমকি দেন।’ এ ঘটনার ভিডিও ফুটেজ টিকটিকে শেয়ার করেন মাসুমা। অনুসারীদের প্রতি ওই ব্যক্তির নামে রিপোর্ট করতে অনুরোধ করেন। কিন্তু কাজের কাজ হয়নি। উল্টো ট্রলের শিকার হতে হয়েছে এই নারীকে। মাসুমা বলেন, ‘ওই ব্যক্তি আমাকে নিয়ে ভিডিও বানিয়ে ছড়িয়ে দিয়েছে। ভিডিওতে আমাকে “যৌনকর্মী” হিসেবে উল্লেখ করেছে।’ পরে টিকটকে মাসুমার অনুসারীরা ভিডিওটি নিয়ে একের পর এক রিপোর্ট করেন। ভিডিওটি নামিয়ে ফেলা হয়। মাসুমা বলেন, ‘কিন্তু তত দিনে আমার যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গেছে।’ এ ঘটনার জেরে মাসুমা অনেক ‘অসংগত ফোনকল’ পেয়েছেন। অনেকে তাঁর সম্পর্কে বিব্রতকর প্রশ্ন করেছে, খোঁজখবর নিয়েছে। পুলিশের কাছে অভিযোগ জানিয়েছিলেন মাসুমা। তিনি বলেন, ‘পুলিশের কার্যকর উদ্যোগ নিতে না পারাটা আমাকে আরও হতাশ করেছিল।’ তবে এই  নিপীড়নমূলক ট্রলিংয়ের বিরুদ্ধে ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে প্রথম সরব হয়েছিলেন কামরুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি। যুক্তরাজ্যের স্ট্যাফোর্ডশায়ারে বসবাসরত কামরুল বলেন, ‘শুরুতে ভেবেছিলাম, এসব ট্রল ভিডিও হয়তো ভুয়া। কিন্তু পরে বন্ধুদের কাছে জানতে পারি, হাসান সায়েদ বহু বছর ধরে যুক্তরাজ্যপ্রাবাসীদের লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে আসছেন।’ অনলাইনে হাসানের সঙ্গে যোগাযোগ করে মানুষকে ট্রল করে ভিডিও প্রকাশ করা বন্ধ করতে বলেন কামরুল। এতে ফল হয় উল্টো। তাৎক্ষণিকভাবে কামরুল ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের ট্রল করেন হাসান। হাসান তাকে নিয়ে ভিডিও বানানো শুরু করেন উল্লেখ করে কামরুল বলেন, তিনি আমার ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টে ঢুঁ দেন। সেখান থেকে আমার এক বছর বয়সী ছেলে, আমার মা ও স্ত্রীর ছবি সংগ্রহ করেন। আমার মা ও স্ত্রীকে ধর্ষণের প্রকাশ্য হুমকি দেন।’ ওই সময় কামরুলের স্ত্রী সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। বাধ্য হয়ে কামরুল দ্বিতীয় সন্তানের অপেক্ষায় থাকা স্ত্রীকে সব খুলে বলেন। পুলিশের কাছে অভিযোগ করার সিদ্ধান্ত নেন তাঁরা। সেই সঙ্গে টিকটক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে ভিডিও সরিয়ে নেওয়ার অনুরোধ করেন। এখানে টিকটক কর্তৃপক্ষও কামরুলের পক্ষে কথা বলেনি। কামরুলকে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়, হাসানের ভিডিওগুলো কমিউনিটি গাইডলাইন লঙ্ঘন করেনি। পুলিশও কামরুলের পক্ষে ব্যবস্থা নিতে এগিয়ে আসেনি। তবে দমবার পাত্র নন কামরুল। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্যারিসে যুক্তরাজ্যের দূতাবাসে যোগাযোগ করেন কামরুল। দূতাবাস  ফরাসি আইনজীবী ম্যাথিউ ক্রোইজেতের সঙ্গে কামরুলের যোগাযোগ করিয়ে দেয়। পরে হাসানের নামে প্যারিসের সরকারি কৌঁসুলির দপ্তরে অভিযোগ আনেন ম্যাথিউ। এতে বলা হয়, ফরাসি আইন লঙ্ঘন করে হাসান তিনটি অপরাধ করেছেন হাসান। এর মধ্যে সহিংস হুমকি দেওয়া, শিশু ও প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিকে ধর্ষণের হুমকি দেওয়া এবং শিশু পর্নোগ্রাফি ও সাইবার বুলিং রয়েছে। তবে বিষয়টি এখনও ঝুলে আছে। মামলার চূড়ান্ত পরিণতি পেতে অনেক সময় লেগে যাবে জানিয়েছেন আইনজীবী ম্যাথিউ। আইনি লড়াই চলা অবস্থায়ও কামরুল ও তাঁর পরিবার নিয়ে ইউটিউব, ফেসবুক ও টিকটকে একের পর এক ট্রল ভিডিও প্রকাশ করেছেন হাসান। এসব ভিডিও নামিয়ে নিতে বললেও সাড়া দেননি হাসান। পরে ২০২৩ সালের এপ্রিলে যুক্তরাজ্যের তথ্য কমিশনারের দপ্তরে যোগাযোগ করেন কামরুল। ভিডিওগুলো পর্যবেক্ষণ করে ব্রিটিশ তথ্য কমিশনারের দপ্তর বলে,  এসব কনটেন্ট বেশ উদ্বেগজনক। এরপরই শিশুদের ব্যক্তিগত তথ্যের অপব্যবহারের বিষয়টি সামনে এনে টিকটক, ইউটিউব ও ফেসবুক কর্তৃপক্ষকে এসব ভিডিও সরিয়ে নিতে বলে তথ্য কমিশনারের দপ্তর। এজন্য সাতদিনের সময় বেধে দেয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে টিকটক, ইউটিউব ও ফেসবুক কর্তৃপক্ষ জানাঢয়, তাদের গাইডলাইনের সঙ্গে মানানসই নয় এমন ভিডিও, কনটেন্ট তারা মুছে ফেলার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট অ্যাকাউন্টটি ব্লক করে দেওয়া হবে। এখনও কামরুল প্রায় প্রতিদিন টিকটকের সঙ্গে যোগাযোগ করে হাসান যেসব নতুন অ্যাকাউন্ট থেকে ভিডিও প্রকাশ করছেন সেসব বন্ধ করার অনুরোধ করলেও টিকটক কর্তৃপক্ষ কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না। প্রায় প্রতিদিন টিকটকের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন জানিয়ে কামরুল আরও বলেন,হাসান যেসব নতুন অ্যাকাউন্ট থেকে ভিডিও প্রকাশ করছেন, সেসব বন্ধ করতে বলছেন। কিন্তু ভুক্তভোগী কামরুলের অভিযোগ, সব সময় কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না।

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন যুক্তরাজ্যে | টিকটকে | ট্রলের | শিকার | বাংলাদেশি | নারীরা | বাড়ছে | আত্মহত্যার | প্রবণতা