বাংলাদেশে আবারও আসছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদল। গত ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের পর দ্বিতীয় বারের মতো বাইডেন সরকারের উচ্চ পর্যায়ের এই প্রতিনিধি দলটি আগামী ২১ এপ্রিল ঢাকায় আসছে। মার্কিন দূতাবাস সূত্রে জানা গেছে, প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেবেন যুক্তরাষ্ট্রেরর বাণিজ্য প্রতিনিধি কার্যালয়ের (ইউএসটিআর) দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী ব্রেন্ডান লিঞ্চ। মার্কিন প্রতিনিধি দলের সফরকে ঘিরে নানা মহলে আলোচনা হলেও ‘নতুন ও গুরুত্বপূর্ণ’ কিছু দেখছে না ঢাকার কূটনৈতিক পাড়ার বাসিন্দা ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা।
২১ এপ্রিল ঢাকা সফরে আসতে যাওয়া মার্কিন প্রতিনিধি দলের অন্য সদস্যদের নাম জানায়নি ডিপার্টমেন্ট অব স্টেট ও ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস। এমনকি ঢাকা-ওয়াশিংটন এই বৈঠকে বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস উপস্থিত থাকবেন কিনা তাও জানায়নি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেবেন।
মার্কিন প্রতিনিধি দলের ঢাকা সফরে দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা ফোরাম চুক্তি (টিকফা) ছাড়াও শ্রম আইন সংস্কার, তথ্য আইনের সুরক্ষাসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হবে বলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
মার্কিন প্রতিনিধি দলের ঢাকা সফরের বিষয়টি এখন কূটনৈতিক পাড়ার আলোচনার টেবিলে। তবে তাদের সফরে ‘নতুনত্ব বা উল্লেখযোগ্য’ কিছু নেই বলে মনে করছেন সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন।
বায়ান্ন টিভিকে তিনি বলেন, ‘এটি একটি রুটিন মাফিক আলোচনা। আগেই নির্ধারণ করা ছিলো। বাইডেন সরকারের নীতি অনুযায়ি যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে অংশীদারিত্বকে গুরুত্ব দেয়। একে আরও গভীর করতে চায়। জলবায়ু, নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুই দেশের আরও নিবিড়ভাবে কাজ করার সুযোগ রয়েছে। তাই চলতি বছরে দুই দেশের মধ্যে একাধিক সফর ও বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। এটিও একটি বৈঠক। এই বৈঠকের এজেন্ডা আগেই ঠিক করা আছে। তাই উল্লেখযোগ্য বা গুরুত্বপূর্ণ কিছু দেখছি না। ’
প্রায় একই মত প্রকাশ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ। আন্তর্জাতিক এই বিশ্লেষক ও শিক্ষাবিদ বায়ান্ন টিভিকে বলেন, ‘প্রতিনিধি দলের সফরে ‘নতুনত্ব’ আছে বলে কিছু দেখছি না। এটি তাদের একটি ‘শিডিউল্ড সফর’। তবে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি দলের বৈঠকের মাধ্যমে টিকফাসহ শ্রম আইন সংস্কার, তথ্য আইনের সুরক্ষাসহ বিভিন্ন বিষয়ে দুই দেশের মধ্যকার দ্বিধা বা আপত্তি নিরসণ করে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নের সুযোগ রয়েছে। বৈঠকে অমীমাংসিত বিষয়গুলোর ব্যাপারে যদি ইতিবাচক কোনো সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় তবেই সফরকে আমরা ‘উল্লেখযোগ্য’ বলে মনে করতে পারি। ’
তবে দু’দেশের প্রতিনিধিদলের বৈঠকে এজেন্ডার বাইরে অন্যান্য বিষয়ও স্থান পেতে পারে বলে মনে করেন সাবেক রাষ্ট্রদূত ও সচিব এ কে এম আতিকুর রহমান।
মালয়েশিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক এই হাইকমিশনার বায়ান্ন টিভিকে বলেন, ‘বিষয়বস্তু আগে ঠিক করা হলেও দু’দেশের প্রতিনিধি দলের বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় অন্যান্য বিষয়ও স্থান পেতে পারে। গত ফেব্রুয়ারিতে পাঠানো জো বাইডেনের চিঠিতে বলা হয়েছে, সমৃদ্ধ, নিরাপদ ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশকে সমর্থন করে যুক্তরাষ্ট্র। এরই ধারাবাহিকতায় বৈঠকে ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্ক জোরদারের উপায়সহ অভিন্ন অগ্রাধিকার ও ভবিষ্যতে যৌথভাবে কাজ করার পথ নিয়ে আলোচনা হতে পারে। এছাড়া, অবাধ ও মুক্ত ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল প্রতিষ্ঠার অভিন্ন স্বপ্ন পূরণে অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠায় ঢাকার সঙ্গে কাজ করার বিষয়টিও বৈঠকে স্থান পেতে পারে।’
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হয় বলে অনেকে মনে করে থাকেন। আওয়ামী লীগ পুনরায় নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করার পরও নির্বাচনের নিরপেক্ষতা ও সুষ্ঠুতা নিয়ে কয়েকবার নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করে যুক্তরাষ্ট্র। তবে নির্বাচনের দু’মাসের মধ্যেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের একটি চিঠি সব ঘুরিয়ে দেয়। সেখানে বাংলাদেশের উন্নয়ন-অগ্রযাত্রায় সহযাত্রী হওয়ার প্রত্যাশা করা হয় যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে। এরই অংশ হিসেবে চলতি বছরের গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় সফরে আসে যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দল।
ঢাকায় সফরে আসা ওই প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক জ্যেষ্ঠ পরিচালক রিয়ার অ্যাডমিরাল এইলিন লাউবেখ। প্রতিনিধি দলে আরও ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি আফরিন আক্তার এবং যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার (ইউএসএআইডি) সহকারী প্রশাসক মাইকেল শিফার।
গত ২৫ ফেব্রুয়ারি বৈঠকের পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক কীভাবে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া যায় সে বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। ‘
এছাড়া, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ও পুনর্বাসন, মানবিক সহায়তা, প্রতিরক্ষা সহযোগিতা, ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় কৌশল, উন্নয়ন সহযোগিতা, সমুদ্রবিষয়ক নিরাপত্তা, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে শক্তিশালীকরণ, নিরাপত্তাসহ দ্বিপক্ষীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো আলোচনায় স্থান পেয়েছে বলেও পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান।
একারণে আসছে ২১ এপ্রিল মার্কিন প্রতিনিধি দলের সফরকেও ইতিবাচক দেখছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র এক কর্মকর্তা বায়ান্ন টিভিকে বলেন, ‘গত ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের পর অনেকেরই ধারণা ছিলো বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের নিয়মিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশের নির্বাচন ও গণতন্ত্র নিয়ে সমালোচনা করায় তাদের ওই ধারণা হয়। তবে গত ফেব্রুয়ারিতে সরকারকে পাঠানো মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের চিঠিতে তাদের ধারণা পাল্টে যায়। ওই চিঠিতে বাংলাদেশের উন্নয়নে সহযাত্রী হওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করা হয় বাইডেন প্রশাসনের পক্ষ থেকে। এরই ধারাবাহিকতায় নির্বাচনের পর দ্বিতীয় বার মার্কিন প্রতিনিধি দলের ঢাকা সফরকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে সরকার।’