প্রতি মৌসুমেই বাম্পার ফলন, বাজারে সরবরাহ পর্যাপ্ত। এরপরও যুক্তি ছাড়াই হুটহাট বেড়ে যায় চালের দাম। এমন চিত্র বিগত প্রায় এক যুগ ধরেই। তবে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়ে রাষ্ট্র সংস্কারের বিস্তৃত এজেন্ডার মধ্যে অন্যতম একটি ছিল বাজার নিয়ন্ত্রণ এবং নিত্যপণ্যকে জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখা। সে অনুযায়ী বিভিন্ন পদক্ষেপের মধ্যে বাজার তদারকি কার্যক্রম জোরদার করার পাশাপাশি খুলে দেয়া হয়েছে আমদানির দরজাও। সবশেষ চালের আমদানি শুল্ক সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে এনবিআর। এতকিছুর পরও কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না চালের দাম। সবশেষ এক মাসে বেড়েছে সর্বোচ্চ ৮ শতাংশ পর্যন্ত।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরবরাহে কোনোরকম সংকট না থাকলেও সরকারের সব নিয়মনীতিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে উৎপাদন এলাকার মিলার ও মজুতদাররা। ঢাকার বাদামতলী, মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট ও কারওয়ান বাজারের কয়েকজন বড় ব্যবসায়ীও জড়িত এই চক্রে। সংঘবদ্ধ এ চালবাজিতে অন্যতম ক্রীড়নক আবার বড় বড় সব করপোরেট প্রতিষ্ঠান।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, দেশে চালের বার্ষিক চাহিদা ৩ কোটি ৭০ লাখ থেকে ৩ কোটি ৯০ লাখ টন। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩ কোটি ৮৯ লাখ ৩৬ হাজার টন এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৩ কোটি ৯০ লাখ ৩৫ হাজার টন চাল উৎপাদন হয়েছে। তবে সবশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছে ৪ কোটি ২০ লাখ টন। সে হিসাবে চাহিদার চেয়ে উৎপাদন বেশি হয়েছে ৩০ লাখ টনের মতো। এতে চাল উদ্বৃত্ত থাকার কথা। যদিও কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, সাম্প্রতিক বন্যায় ৮ লাখ ৩৯ হাজার টন চালের উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, বছরের শুরু থেকেই এবার চড়া ছিল চালের বাজার। গত জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় তা আরও বেড়ে যায়। এরপর আর স্বস্তি ফেরেনি বাজারে। গত সপ্তাহে আরেক দফা বেড়েছে দাম। বাজারে সবচেয়ে বেশি চাহিদা মাঝারি আকারের বিআর-২৮ ও পাইজাম জাতের চালের। এ ধরনের চালের ভোক্তা সাধারণত নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণি। গত শুক্রবার ঢাকার বাজারে খুচরা পর্যায়ে এ দুই জাতের চালের কেজি বিক্রি হয়েছে ৫৮-৬৪ টাকায়। এছাড়া মোটা চালের (গুটি স্বর্ণা ও চায়না ইরি) কেজি ৫২-৫৫ টাকা ও চিকন চাল (মিনিকেট) বিক্রি হয়েছে কেজি ৭০-৮০ টাকা দরে। অথচ, মাস তিনেক আগেও মোটা চালের কেজি ৪৮-৫০, মাঝারি চাল ৫৪-৫৮ এবং চিকন চাল ৬৮-৭০ টাকায় বিক্রি হয়েছিল।
টিসিবির হিসাব অনুযায়ী, গত এক মাসে সরু চালের দর প্রায় ৪ শতাংশ, মাঝারি চালের দর ৮ শতাংশ ও মোটা চালের দর ২ শতাংশ বেড়েছে। তবে, এক বছরের তুলনামূলক হিসাব সামনে আনলে এই দামবৃদ্ধির হার আরও বেশি। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে গড়ে ১২ শতাংশ বেড়েছে সব ধরনের চালের দাম।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, বর্তমানে চালের মজুত রয়েছে ৯ লাখ ৬৮ হাজার টন। তবে সরকারের নিরাপত্তা মজুত হিসেবে সাধারণত ১১ লাখ টন চাল রাখার কথা বলা হয়ে থাকে। অর্থাৎ ১ লাখ ৩২ হাজার টন চালের ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে সরকারি খাদ্যভাণ্ডারে।
উৎপাদন অঞ্চলের মিলার ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে ধানের মৌসুমে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান কিনে মজুত করছে বড় বড় করপোরেট কোম্পানিগুলো। আবার বাজারে ধানের কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে চালের দামও বাড়াচ্ছে তারাই। সরকারের নিয়মিত মনিটরিং ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের অভাবেই মূলত বেপরোয়া হয়ে উঠছেন করপোরেট ব্যবসায়ী ও মিলমালিকরা।
যাত্রাবাড়ীর ভাই ভাই চালের আড়ত মালিক মিলন গণমাধ্যমকে বলেন, বাজারে বড় বড় কোম্পানিগুলোর চালের সরবরাহ বেশি। তাদের চালের মানও ভালো। তাই একচেটিয়া ব্যবসা করছে করপোরেট কোম্পানিগুলো। যেভাবে চালের বাজার বড় কোম্পানিগুলোর দখলে যাচ্ছে তাতে চালের দাম আর কমবে বলে মনে হয় না।
এসব ব্যাপারে খাদ্য সচিব মাসুদুল হাসান গণমাধ্যমকে বলেন, চালের যে সংকট নেই, তা পুরোপুরি সত্য। কারণ, আমি নিজে কারওয়ান বাজারে গিয়ে দেখেছি, প্রতিটি আড়ত চালে ভরা। অন্য জেলাগুলোতেও নিশ্চয়ই পর্যাপ্ত চাল রয়েছে। দাম বৃদ্ধি পাওয়ার কোনো যুক্তি দেখছি না।
তিনি আরও বলেন, কিছু ব্যবসায়ী সরকারকে চাপে ফেলার জন্য সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করছে। এ ক্ষেত্রে আমরা আইনের সর্বোচ্চ প্রয়োগ করব। সিন্ডিকেটকে ছাড় দেওয়া হবে না।
উল্লেখ্য, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৩ লাখ ৫০ হাজার টন চাল আমদানির জন্য ২ হাজার ৯০৮ কোটি টাকা বাজেট বরাদ্দ রয়েছে। বাকি ৭ লাখ ৫০ হাজার টনের জন্য আরও ছয় হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ লাগবে। এ অবস্থায় বাজারে চালের সরবরাহ বাড়াতে আমদানিতে উৎসাহ দিচ্ছে সরকার। আমদানিতে মোট করভার ৬২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে দুই দফা কমিয়ে মাত্র ২ শতাংশ অগ্রিম কর রাখা হয়েছে। অর্থাৎ আমদানিতে ৬০ দশমিক ৫ শতাংশ শুল্ককর প্রত্যাহার করা হয়েছে। তাতে চালের আমদানি মূল্য কেজিতে প্রায় ৯ টাকা ৬০ পয়সা কমার কথা। শুল্ক প্রত্যাহার হলেও ব্যক্তি মালিকানাধীন ভাণ্ডারে মজুত চাল বেশি দামে বিক্রির জন্য আমদানি করছে না সিন্ডিকেট চক্রটি। বন্যার ছুতায় নিরুৎসাহিত করছে অন্যদেরও।
এএম/