ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের হাম্পি শহরের কাছে সানাপুর হ্রদের পাড়ে নিশুতি রাতে সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে যাওয়া এক ইসরায়েলি তরুণীকে গণধর্ষণ করা হয়। এই ঘটনার ফলে দেশটির পর্যটন খাতে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এ ঘটনার পর পর্যটকদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে এবং অনেক বিদেশি পর্যটক ভারত ছাড়ছেন। এছাড়া, ভারতে বিদেশি পর্যটকদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। গত কয়েকদিনে বহু বিদেশি পর্যটক ইউনেস্কোর ওই ঐতিহ্যবাহী স্থান ছেড়ে চলে গেছেন বলেও দেশটির সংবাদমাধ্যমে খবর এসেছে।
বুধবার (১২ মার্চ) আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা বিবিসি’র প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অনেক বিদেশি পর্যটক বুকিং বাতিল করেছেন। অনেকে আবার তাদের পূর্ববর্তী ভ্রমণ পরিকল্পনা পরিবর্তন করে অন্যত্র যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
গত বৃহস্পতিবার রাতে যাদের সঙ্গে এই ঘটনা ঘটে তাদের মধ্যে ছিলেন স্থানীয় হোমস্টে অপারেটর হিসেবে কর্মরত এক নারী, ইসরায়েলি এক নারী পর্যটক, এক মার্কিন নাগরিক, মহারাষ্ট্রের একজন বাসিন্দা ও উড়িষ্যার এক যুবক।
নিঝুম রাতের আকাশে তারা দেখার জন্য বেরিয়েছিলেন তারা। ভালোই চলছিল সব কিছু। গিটার বাজিয়ে গান গেয়ে রাতের পরিবেশ উপভোগ করছিলেন তারা।
হঠাৎ করে মোটরসাইকেলে করে আসা তিন আগন্তুকের কারণে পাল্টে যায় সব কিছু্। প্রথমে তর্ক, পরে এক পর্যায়ে হামলা, ইসরায়েলি এক পর্যটকসহ দুই নারীকে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা ঘটে।
কোপ্পালের পুলিশ সুপার রাম আরাসিদ্দি বলেছেন, সানাপুরের কাছে ৬ মার্চ পাঁচজনের ওপর হামলা হয়। এর মধ্যে দুজন বিদেশি পর্যটক। হামলাকারীরা পুরুষদের মারধর করে হ্রদের পানিতে ফেলে দেয় এবং দুই নারীর ওপর যৌন নির্যাতন চালায়।
পানিতে ফেলে দেয়া এক যুবক মারা যান, কারণ তিনি সাঁতার জানতেন না। ভুক্তভোগীদের অভিযোগের ভিত্তিতে হত্যা, চুরি ও ধর্ষণের মামলা দায়ের করা হয়েছে।
পুলিশ জানিয়েছে, ওই মার্কিন যুবক এবং মহারাষ্ট্র থেকে আসা অন্য এক পর্যটক যাদের খালে ঠেলে ফেলে দেওয়া হয়েছিল বলে অভিযোগ, তারা সুস্থ আছেন। পরে যে পর্যটকের মরদেহ উদ্ধার হয়, তিনি উড়িষ্যার বাসিন্দা।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর বলেছে, মার্কিন নাগরিকের ওপর এই হামলার ঘটনার বিষয়ে তারা অবগত। এই ঘটনায় সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে কর্ণাটক পুলিশ দুই ব্যক্তিকে আগেই গ্রেপ্তার করেছিল।
পরে ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে আরো এক যুবককে সোমবার গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এই ঘটনায় কোপ্পালের পুলিশ সুপারের কাছে রিপোর্ট তলব করেছে কর্ণাটকের রাজ্য মহিলা কমিশন।
ঘটনাটি ৬ মার্চ রাতে কর্ণাটকের হাম্পি হেরিটেজ সাইট থেকে প্রায় ২৮ কিলোমিটার দূরে সানাপুর গ্রামের কাছে ঘটে। বিজয়নগর সাম্রাজ্যের রাজধানী হাম্পি বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী স্থানের অন্তর্ভুক্ত। বিপুল সংখ্যক পর্যটক বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এই ঐতিহ্যবাহী স্থল পরিদর্শনে আসেন।
বিদেশি পর্যটকদের মধ্যে বড় অংশ যান ইসরায়েল এবং ইউরোপ থেকে। এই পর্যটকদের বড় অংশই মূলত সানাপুরে থাকেন, যেখানে প্রাচীন স্থাপত্যের ধ্বংসাবশেষ এবং একটি বিখ্যাত হিন্দু মন্দিরও রয়েছে।
ধর্ষণের শিকার দুই নারীর মধ্যে একজনের বয়স ২৯ বছর, তিনি হোমস্টে অপারেটর হিসেবে কর্মরত। ওইদিন রাতে তিনজন পুরুষ পর্যটক এবং এক ইসরায়েলি নারী পর্যটককে সঙ্গে নিয়ে সানাপুর লেকের কাছে অবস্থিত তুঙ্গভদ্রা রিভার ক্যানেলে গিয়েছিলেন তিনি। উদ্দেশ্য ছিল, রাতের আকাশে নক্ষত্র দেখা।
পুলিশ জানিয়েছে, স্টার গেজিং বা আকাশে নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ নিয়ে পর্যটকদের মধ্যে আকর্ষণ বাড়ছে। ওই অঞ্চলের বহু হোমস্টে এবং রিসোর্ট বিদেশি পর্যটকদের স্টার গেজিংয়ের জন্য ব্যবস্থা করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দেয়।
পুলিশের তদন্তে জানা গেছে, রাত সাড়ে ১০টার দিকে তিনজন ব্যক্তি মোটরসাইকেলে করে এই দলটির কাছে জানতে চান কাছাকাছি কোথায় পেট্রোল পাওয়া যাবে?
হোমস্টে অপারেটর ওই নারী তাদের জানান, কাছাকাছি কোনো গ্যাস স্টেশন নেই। তাদের তারা সানাপুরে খোঁজ নেওয়ার পরামর্শও দেন তিনি। তখন আচমকাই আগতদের মধ্যে একজন তাদের কাছে ১০০ টাকা দাবি করেন বলে অভিযোগ।
ওই নারী বার্তা সংস্থা এএনআইকে বলেন, আমি তাদের জানাই যে আমার কাছে কোনো টাকা নেই। কিন্তু তারা ক্রমাগত জোর করতে থাকায় আমাদের দলের এক পুরুষ পর্যটক তাদের ২০ টাকা দেন। কিন্তু ওই তিনজন ব্যক্তি আরও টাকা দাবি করতে থাকেন। দাবি অনুযায়ী টাকা না মেলায় তারা আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। ক্রমে দুই পক্ষের মধ্যে তর্কাতর্কি শুরু হয়ে যায়।
হোমস্টে অপারেটর ওই নারী বলেন, পাথর হাতে নিয়ে তাদের আঘাত করার হুমকি দিতে থাকে ওই তিন যুবক। পরিস্থিতি আরও বিরূপ আকার নেয়। তারা দুই নারীকে ধর্ষণ ও মারধর করে।
অভিযোগকারী নারী পুলিশকে জানিয়েছেন, এ সময় পুরুষ পর্যটকদের খালে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া হয়। তাকে পাথর দিয়ে আঘাত করা হয় এবং ব্যাগ ছিনিয়ে নেয়া হয়।
অভিযুক্তরা দুটি মোবাইল ফোন এবং নগদ নয় হাজার ৫০০ টাকাও নিয়ে নেয় বলে পুলিশে অভিযোগ জানিয়েছেন তিনি। এরপর ইসরায়েলি নারী পর্যটককেও জোর করে তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করা হয় বলে অভিযোগ উঠেছে।
ভারতীয় ওই নারী বলেন, আমরা চিৎকার করছিলাম, কান্নাকাটি করছিলাম। ওই তিনজন মোটরসাইকেলে চেপে পালিয়ে যায়। এরপর পুলিশ তদন্ত শুরু করে এবং তিনজনকে ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
ঘটনার পর প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিরাপত্তার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে পুলিশি টহলও। কিন্তু তা সত্ত্বেও, পর্যটকদের মধ্যে আতঙ্ক রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
কর্ণাটক ট্যুরিস্ট গাইডস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক বিরুপাক্ষ ভি হাম্পি বিবিসিকে বলেছেন, প্রতি বছর সব মিলিয়ে প্রতি এক লাখ বা তারও বেশি বিদেশি পর্যটক এই এলাকায় বেড়াতে আসেন। তবে হামলার খবর প্রকাশ্যে আসার পর থেকে বেশিরভাগ দর্শনার্থী হয় বুকিং বাতিল করেছেন অথবা এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন।
একই কথা জানিয়েছেন ওই অঞ্চলে ট্যুর গাইড হিসাবে কর্মরত সৈয়দ ইসমাইল। তিনি বিবিসিকে বলেন, প্রায় ৯০ শতাংশ পর্যটক যাদের অধিকাংশই ইসরায়েলের নাগরিক, বৃহস্পতিবারের ঘটনার পর ওই এলাকার হোমস্টে ছেড়ে চলে গেছেন।
ইসমাইল আরো বলেন, যারা এখনো রয়ে গেছেন, তাদের দলবদ্ধভাবে চলাফেরা করতে এবং খুব দূরে না যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। পর্যটকদের কেউ কেউ জানিয়েছেন, ভ্রমণ পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনতে বাধ্য হয়েছে তারা।
তালিয়া জিলবার নামে ইসরায়েলি পর্যটক ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেছেন, এই ঘটনাটি সত্যিই ভয়ের এবং আমরা আমাদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। হোলি উৎসব পর্যন্ত আমাদের এখানে থাকার পরিকল্পনা ছিল, কিন্তু এখন আমরা রাজস্থান চলে যাচ্ছি।
বছর ২১-এর ওই তরুণী তার পাঁচ বন্ধুর সঙ্গে হাম্পি ভ্রমণের উদ্দেশে এসেছিলেন। রোববার তারা ওই এলাকা ছেড়ে চলে যান।
কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়া এই ঘটনার নিন্দা জানিয়ে পর্যটকদের নিরাপত্তার বিষয়ে আশ্বাস দিয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে তিনি লিখেছেন, "কোপ্পাল জেলার গঙ্গাবতী তালুকের সানাপুরে এক ইসরায়েলি নাগরিক এবং হোমস্টে অপারেটরের ওপর হামলা ও ধর্ষণ একটি জঘন্য অপরাধ। ঘটনাটি জানা মাত্রই আমি সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের তদন্ত করে দোষীদের দ্রুত গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়েছি।"
তিনি আরও বলেন, "আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, আমাদের রাজ্যে আসা প্রতিটি মানুষের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে। এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।"
কংগ্রেসের সাংসদ জিসি চন্দ্রশেখর এই ঘটনার নিন্দা করেছেন এবং একে দুর্ভাগ্যজনক বলেছেন। কর্ণাটকের মন্ত্রী শিবরাজ টাঙ্গাদাগি পর্যটকদের গভীর রাতে ভ্রমণ না করার পরামর্শ দিয়েছেন।
ঘটনার পর ওই এলাকাসহ আশপাশের সমস্ত পর্যটন কেন্দ্র এবং হোটেলে কড়া নজরদারি শুরু করেছে পুলিশ। রাতে পুলিশি টহল বাড়ানো হয়েছে এবং সোমবার কোপ্পালের পুলিশ সুপার রাম আরাসিদ্দি সানাপুর, আনেগুণ্ডি, বাসপুরা ও বাসপুর অঞ্চলের হোমস্টে এবং হোটেল পরিদর্শন করেন। তিনি হোটেলগুলোতে অবস্থানকারী সমস্ত আবাসিকের বিষয়ে খোঁজখবর নেন।
২০১৭ সালে গোয়ায় এক বিদেশি তরুণীকে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় গোটা ভারত তোলপাড় হয়েছিল। ওই ঘটনায় গ্রেপ্তার ব্যক্তিকে সম্প্রতি দোষী সাব্যস্ত করেছে আদালত।
এসি//