বাংলা ভাষার ভিজে স্যাঁতসেঁতে দেহের ভেতরে যে তেজোদীপ্ত লাভা থাকতে পারে, ভাষা যে ডিনামাইটের মতো বিধ্বংসী হতে পারে কাজী নজরুলের জন্ম না হলে অর্থাৎ তার সাহিত্য সৃষ্টি না হলে তা হয়তো বিশ্ববাসীর কাছে অজানাই থেকে যেত। তাইতো প্রেম ও দ্রোহের কবি বলেছেন-বল বীর, বল উন্নত মম শির’ অথবা মহা-বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত/আমি সেই দিন হব শান্ত/যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দল-রোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না,/অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না-’।
বাংলা সাহিত্যে ধুমকেতুর মতো আবির্ভাব কাজী নজরুল ইসলামের ১২৬তম জন্মবার্ষিকী আজ ১১ জ্যৈষ্ঠ।সারা দেশে নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে উদ্যাপিত হচ্ছে ‘নজরুল জয়ন্তী। জাতীয় পর্যায়ে কুমিল্লায় আজ রোববার শুরু হচ্ছে তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠান। এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান: কাজী নজরুলের উত্তরাধিকার’। অনুষ্ঠানগুলো সবার জন্য উন্মুক্ত।
কাজী নজরুল ছিলেন শোষণের বিরুদ্ধে শোষিতের দৃঢ় প্রতিবাদ, অন্যায় আর অসত্যের বিরুদ্ধে নজরুলের লেখনি শাসকদের অস্তিত্ব নড়বড়ে করে দিয়েছিল। শোষিত মানুষের পক্ষে কলম ধরায় যুগবাণী, বিশের বাঁশিসহ তার পাঁচটি গ্রন্থ বাজেয়াপ্ত করে ব্রিটিশ সরকার। কোনো কবির এতগুলো গ্রন্থ একসাথে বাজেয়াপ্ত করার রেকর্ড নেই। ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতার জন্য রাজদ্রোহের মামলায় জেলে পাঠানো হয় কবি নজরুলকে। সেখানেও নজরুলের কলম থেমে থাকেনি।
সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মগ্রহণ করেননি কাজী নজরুল ইসলাম। বাবা ছিলেন স্থানীয় মসজিদের ইমাম । তিনি নিজেও মসজিদে মুয়াজ্জিন হিসেবে কাজ করতেন, আযান পাঠ করে মুসল্লিদের নামাজের জন্য ডাকতেন।পরে তিনি একটি নাট্যদলের সাথে কাজ করেন। কাজ করেছেন রুটির দোকানে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতেও কাজ করেন। সামরিক বাহিনীতে যোগদানের পর, তিনি কলকাতায় সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেন, যেখানে তার সমাজ সংস্কার আন্দোলনের বীজ রোপিত হয়েছিল।
ডাগর ডাগর চোখের প্রেমকাতুর চাহনির নজরুল ছিলেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান রোমান্টিক কবি। ইংরেজি সাহিত্যের জন কীটস, পি বি শেলির চাইতে কোনো অংশে কম নন তিনি। প্রেম, প্রেম থেকে শুরু করে আধ্যাত্মিকতা এবং স্বাধীনতা পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয়ের উপর তিনি লিখেছেন। তাঁর সাহিত্যকর্ম তাঁকে বাংলায় "বিদ্রোহী কবি" বা "বিদ্রোহী কবি" উপাধিতে ভূষিত করেছে।
তার কবিতায় যেমন আছে রোমান্টিকতা, তেমনি আছে বিদ্র্রোহের ‘আগুন বার্তা’। তাইতো ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের কিংবদন্তি নেতাজি সুভাস চন্দ্র বসু একবার আজাদ হিন্দ ফৌজকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, “যুদ্ধের সময় নজরুলের গান গাওয়া হবে, গান গাওয়া হবে জেলে যাওয়ার সময়ও।”
নজরুলকে বিশ্ব সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি হিসেবে এবং তাঁর বিদ্রোহী কবিতাকে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম তাৎপর্যপূর্ণ কবিতা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন মার্কিন ফোকলোরবিদ ও সাহিত্য-সমালোচক প্রফেসর ড. হেনরি গ্লাসিসহ পশ্চিমা বিশ্বের খ্যাতনামা মনীষীরা। প্রফেসর হেনরি গ্লাসি তাঁর বিবেচনায় দুটো কবিতাকে শ্রেষ্ঠতম বলে প্রকাশ করেছেন -তার একটি হচ্ছে কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’।
১৯৬৫ সালে কবির বন্ধু ও ভারতে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব মুজফ্ফর আহমদ কবি সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘বিদ্রোহ ‘ কবিতাটি রচিত হয়েছিল ১৯২১ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে। আমার মনে হয়, নজরুল ইসলাম শেষ রাত্রে ঘুম থেকে উঠে কবিতাটি লিখেছিল। তা না হলে এত সকালে সে আমায় কবিতা পড়ে শোনাতে পারত না। এখন থেকে চুয়াল্লিশ বছর আগে নজরুলের কিংবা আমার ফাউন্টেন পেন ছিল না। দোয়াতে বারে বারে কলম ডোবাতে গিয়ে তার মাথার সঙ্গে তার হাত তাল রাখতে পারবে না, এই ভেবেই সম্ভবত সে কবিতাটি প্রথমে পেন্সিলে লিখেছিল।’
কবি, সংগীতজ্ঞ, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, কীর্তন ও ভজন লেখক, সাংবাদিক, চলচ্চিত্রকার, গায়ক, চিত্রনাট্যকার, সংগীত পরিচালক ও অভিনেতা-কোথায় নেই কাজী নজরুল। তিনি বৈচিত্র্যময় অসংখ্য রাগরাগিণী সৃষ্টি করে বাংলা সংগীতজগতকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। তাঁর লেখা এবং সুর করা ৪০০০-এরও বেশি গানের সংকলন নজরুল গীতি নামে পরিচিত এবং আজও বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীর কাছে এটি ব্যাপক জনপ্রিয়।
মুসলমানদের অন্যতম ধর্মীয় ও আনন্দের উৎসব ঈদ-উল-ফিতর নিয়ে বাঙ্গালী কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত কালজয়ী গান। বাঙ্গালী মুসলমানের ঈদ উৎসবের আবশ্যকীয় অংশ। কবির শিষ্য শিল্পী আব্বাস উদ্দিন আহমদ-এর অনুরোধে ১৯৩১ সালে কবি নজরুল এই গান রচনা ও সুরারোপ করেন। ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ/তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানী তাগিদ। যতদিন বাঙালি মুসলমান থাকবে ততদিন এই সংগীতের মধ্যৗ দিয়ে অমর হয়ে থাকবেন কাজী নজরুল।
কবি নজরুল শুধুমাত্র বাঙালির নয়, তিনি বিশ্বের শোষিত ও নিপীড়িত মানুষের। আপাদমস্তক সাম্যবাদী এই কবির অসংখ্য কবিতা সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হতো। রুটির দোকানের সামান্য বেতনের কর্মচারী থেকে উঠে আসা এই মানবতাবাদী কবির শতাধিক কবিতা ইংরেজি, রুশ, জার্মানসহ ৪০টিরও বেশি ভাষায় অনুবাদ হয়েছে।
বাংলা গানের যে বিশাল এক সম্ভার, এই সম্ভারে অকৃত্রিমভাবে চর্যাপদ থেকে আধুনিক কাল পর্যন্ত অনেকেই অবদান রেখেছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন কাজী নজরুল ইসলাম।
একজন অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ হিসেবে তিনি ইসলামিক গান যেমন লিখেছেন, তেমনি লিখেছেন ভজন, শ্যামা সংগীত, আরাধনা সংগীত অনেক কিছু।অনেক ভজন, শ্যমা সঙ্গীত প্রভৃতির মাঝে জনপ্রিয় কিছু গান উল্লেযোগ্য--এল নন্দের নন্দন নব-ঘনশ্যাম; ব্রজ গোপী খেলে হোরী খেলে আনন্দে নব ঘন-শ্যাম সাথে;হে গোবিন্দ রাখ চরণে।
কবি কাজী নজরুল শুধু বাংলাদেশের নয়, পুরো বিশ্বের। বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে বহু দূর চলে গেছে এই সীমানা। জাপানের টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নজরুলের সাহিত্য নিয়ে গবেষণা করে ডক্টরেট করেছেন অনেকে। শুধু তাই নয়, যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ, যুক্তরাষ্ট্রের কানেকটিকাট বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য দেশের শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নজরুল সাহিত্য পড়ানো হয়।
কাজী নজরুলই বিশ্বের একমাত্র কবি যার একটি কবিতার (বিদ্রোহী) ৯০ বছর পূর্তি রাষ্ট্রীয়ভাবে উদযাপন করেছে দুই রাষ্ট্র-বাংলাদেশ ও ভারত। দুই দেশেই তাঁর নামে বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। আর এসব সম্ভব হয়েছে নজরুল বলেই।