ঘনিষ্ঠদের তিনি বলতেন, ‘টাকা দেখলে তার ঘেন্না’ লাগে। তার আসক্তি ছিল ডলার’ কিংবা ‘ইউরো’তে। দেশে টাকা নিতেন না। দুর্নীতির অর্থের লেনদেন করতেন বিদেশে। এখন পর্যন্ত বিশ্বের ১৬টি দেশে তার নিজের ও পরিবারের সম্পদের সন্ধান পাওয়া গেছে।
আলোচিত এই ব্যক্তির নাম নসরুল হামিদ বিপু। আওয়ামী থিঙ্কট্যাঙ্ক সিআরআইয়ের প্রধান অর্থ জোগানদাতা পতিত স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠজন। সাবেক বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী।
তবে অনেকেই ধারণা করছেন, আরও অনেক দেশেই বিপুর লুটপাটের টাকা আছে। এখন পর্যন্ত যেসব দেশে বিপুর অর্থের সন্ধান পাওয়া গেছে, তার মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, বারমুডা, মাল্টা, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড, মোনাকো, সাইপ্রাস ও তুরস্কের নাম জানা গেছে। আমেরিকায় একটি কোম্পানি খুলে ওই কোম্পানির মাধ্যমে নসরুল হামিদ বিপুর হাজার কোটি টাকা পাচার করেছেন বলে অভিযোগ আছে। ওই কোম্পানি প্রতিষ্ঠার সময় বিপু যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় তার নিজের বাসভবনের ঠিকানা ব্যবহার করেছেন। পাঁচ বেডরুমের ওই বাসার বাজারমূল্য ৩৬ লাখ ১৭ হাজার ৪১৫ মার্কিন ডলার। বাংলাদেশি টাকায় এর দাম হয় ৪২ কোটি ৩৪ লাখ টাকা।
সেখানে শরীফ হায়দার নামে এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে স্ত্রী সীমা হামিদকে নিয়ে ‘পাথ ফাইন্ডার ইন্টারন্যাশনাল’ নামে একটি ট্রেড করপোরেশনের লাইসেন্স নিয়েছেন বিপু। এই করপোরেশনের আওতায় মোবিল গ্যাস স্টেশনসহ দেড় ডজনের মতো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। ফ্লোরিডায় অবস্থিত ওই গ্যাস স্টেশনটি কিনতে খরচ করা হয় কয়েক মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই শরীফ হায়দারের মাধ্যমেই হাজার কোটি টাকা যুক্তরাষ্ট্রে পাচার করেছেন বিপু।
বিপুর স্ত্রী সীমা হামিদের নামে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইতে তিনটি বিলাস বহুল অ্যাপার্টমেন্ট আছে। বিপুর ছেলে জারিফ হামিদ বসবাস করেন দুবাইয়ের পাম বিচে বিলাসবহুল একটি বাংলোতে। সেখানে তাদের একাধিক ব্যবসা রয়েছে। লন্ডনে স্ট্রাটফোর্ড এলাকায়ও বিপুর বাড়ি আছে। এ ছাড়াও ম্যানচেস্টারে রয়েছে বিপুর ব্যবসা। কানাডায় একটি আবাসিক হোটেল এবং একটি পেট্রোল পাম্পের মালিক বিপু। তার তিনটি প্রতিষ্ঠান সিঙ্গাপুরে স্টক এক্সচেঞ্জ নিবন্ধিত। যেখানে বিপুর হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ আছে। বিপুর স্ত্রী সীমা হামিদের নামে মাল্টায় একটি বার ও ক্যাসিনোর খোঁজ পাওয়া গেছে। মালয়েশিয়ায় জারিফ রাবার ফ্যাক্টরি নামে একটি কারখানা আছে। ওই কারখানার বেশিরভাগ শেয়ার বিপুর ছেলে জারিফের। এই শেয়ারের দাম বাংলাদেশি টাকায় সাড়ে আটশ কোটি টাকা। বিদ্যুৎ খাত থেকে লুট করে এসব টাকায় বিভিন্ন দেশে পাচার করে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন বিপু।
অভিযোগ আছে, কোনো বিদ্যুৎ প্রকল্প শুরু করে অনুমোদন পর্যন্ত কমপক্ষে ২০টি ধাপে টাকা আদায় করতো বিপু চক্র। প্ল্যানিং, সাইট ভিজিট, মেশিনপত্র অনুমোদন দেওয়া, নেগোসিয়েশন, প্রকল্পের সাইট সিলেকশন, মাটি ভরাট, জমি ক্রয়, বিদ্যুৎ ক্রয়ের দরদাম ঠিক করা, বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করা বা কমিশনিং, মন্ত্রণালয়ে রিপোর্ট পাঠানো, ক্রয় অনুমোদন, বিল অনুমোদন, বিল ছাড় করা অর্থাৎ প্রতিটি খাতে এ চক্রকে টাকা দিতে হতো।
শুধু তাই নয়, বিদ্যুৎ খাতের বিভিন্ন কোম্পানির নানা কেনাকাটা এবং উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর অনুমোদন দেওয়া, বিভিন্ন কেনা-কাটাসহ লোভনীয় কমিটিতে পছন্দের কর্মকর্তাদের রাখা, পদোন্নতি, পোস্টিং দিয়েও এ চক্র হাতিয়ে নিতো কোটি কোটি টাকা। এছাড়া বিভিন্ন কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে যাওয়ার জন্যও এই চক্রকে মোটা অঙ্কের টাকা দিতে হতো। নিজস্ব লোকদের দিয়ে প্রকল্পের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মিডিয়ায় রিপোর্ট করিয়ে প্রকল্পের পিডি বা কোম্পানির শীর্ষ কর্মকর্তাদের ব্ল্যাকমেইল করতো সিন্ডিকেট সদস্যরা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ওই সিন্ডিকেটের সক্রিয় সদস্য ছিলেন সাবেক প্রতিমন্ত্রীর ছোট ভাই ইন্তেখাবুল হামিদ অপু এবং সাবেক সেতুমন্ত্রীর এক ভাতিজা। এই চক্রের অবৈধ আয়ের হিসাবনিকাশ করতেন প্রতিমন্ত্রীর এপিএস মুজাহিদুল ইসলাম মামুন, কেরানীগঞ্জের প্রভাবশালী শাহীন চেয়ারম্যান এবং জনসংযোগ কর্মকর্তা মীর আসলাম। তারা ক্যাশিয়ার হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
নসরুল হামিদের ছোট ভাই ইন্তেখাবুল হামিদ অপু এবং সেতুমন্ত্রীর এক ভাতিজা মিলে চারটি কোম্পানির মাধ্যমে পাঁচ বছরে বাগিয়ে নিয়েছেন ৮ হাজার কোটি টাকার কাজ। অভিযোগ আছে, শুধু ইনফরমেশন টেকনোলজি সেক্টরে তারা বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন ১২টি বড় মেগা প্রকল্প। ২০২০-২০২১ অর্থবছরে ঢাকা পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি (ডিপিডিসি) ও নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি (নেসকো) থেকে অ্যাডভান্সড মিটারিং ইনফ্রাস্ট্রাকচার (এএমআই) নামের দুটি প্রকল্প হাতিয়ে নেয় এই চক্র। এ দুটি ছিল ২ হাজার কোটি টাকার। এ ছাড়া ২০২১-২০২২ অর্থবছরে একই কোম্পানি মোবাইল অ্যাপস অ্যান্ড কাস্টমার পোর্টাল প্রতিষ্ঠার নামে ডিপিডিসির কাছ থেকে হাতিয়ে নেয় আরও একটি বড় মেগা প্রকল্প। ওই প্রকল্পের খরচ ছিল ৫০০ কোটি টাকা। নসরুল হামিদ বিপুর ভাই একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিলিং প্রকল্পের নামে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি), ডিপিডিসি, নেসকো, বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড (পিডিবি), ঢাকা ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকো), থেকে প্রায় সাতটি মেগা প্রকল্প হাতিয়ে নিয়েছেন। এসব প্রকল্পের মোট মূল্য ছিল ৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি। অন্যদিকে দুটি বড় টেক কোম্পানির মাধ্যমে ডেটা সেন্টার স্থাপনের নামে বিদ্যুৎ খাতের এ ছয় কোম্পানি থেকে তারা হাতিয়ে নেন আটটি মেগা প্রকল্প। শুধু তাই নয়, নসরুল হামিদ বিপুর ক্ষমতার অপব্যবহার করে তার ছোট ভাই একটি কোম্পানির মাধ্যমে নেটওয়ার্ক অ্যান্ড সিকিউরিটি নামে আটটি মেগা প্রকল্প হাতিয়ে নেন। এর মধ্যে ২০২৩ সালের ১ জুন পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড আরইবির কাছ থেকে হাতিয়ে নেন ৫০ লাখ মিটার স্থাপনের কাজ।
এই প্রকল্পটির মোট খরচ ছিল ২৩শ কোটি টাকা। শুধু তাই নয়, কুইক রেন্টাল থেকে প্রতি মাসে কোটি কোটি টাকা মাসোয়ারা আদায় করার দায়িত্ব অপুকে দিয়েছিলেন বিপু। অপুর মূল কাজ ছিল নসরুল হামিদের সঙ্গে থেকে বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্র অনুমোদন দেয়া, অনুমোদনের জন্য কমিটি করা, কেন্দ্র যাচাইবাছাই করা, কেন্দ্রগুলোর অনিয়ম-দুর্নীতির তদন্ত করা। এভাবে ব্ল্যাকমেইল করে তিনি নসরুল হামিদকে মাসে শত শত কোটি টাকা আয় করে দিতেন।