মহামারি মোকাবেলায় ভারত চলতি বছরের জানুয়ারি মাস থেকে করোনা টিকা পাঠাতে শুরু করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। আগামী মাসের শুরু থেকে ১৮ বছরের বেশি বয়সী নাগরিকদের কোভিড টিকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারত সরকার। এ অবস্থায় দেশটিকে টিকা রপ্তানি পুরোপুরি বন্ধ করে দিতে হবে বলে আশঙ্কা করছে বিশেষজ্ঞরা।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি জানায়, ভারতে তিন মাস আগে করোনার টিকা অভিযান শুরু হয়েছে। তবে এর মধ্যেই টিকা উৎপাদন প্রচন্ড চাপের মুখে পড়েছে। টিকার অভাবে বহু সেন্টার বন্ধ করে দিতে হয়েছে।
এই পটভূমিতে বিবিসিকে একাধিক বিশেষজ্ঞ বলেছে, সব প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিককে টিকা দেওয়ার অর্থ হল ভারতের টিকা মৈত্রী বা টিকা কূটনীতির আপাতত এখানেই অবসান ঘটছে। ফলে বাংলাদেশসহ যেসব দেশ শুধু ভারতে তৈরি টিকার অপেক্ষায় আছে এই সিদ্ধান্তে প্রভাব পড়বে সেসব দেশে।
এই মুহুর্তে ভারতে ৪৫ এর ওপর বয়সীরাই একমাত্র কোভিডের টিকা নিতে পারছে। তবে আগামী এক মে থেকে সব প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের জন্যই টিকা কর্মসূচি উন্মুক্ত করা হচ্ছে। এর অর্থ দেশের জনসংখ্যার প্রায় দুই তৃতীয়াংশ বা ৯০ কোটির মতো মানুষকে অভিযানের আওতায় আনতে চাইছে সরকার। তবে এখন যে দুটি টিকা ব্যবহার করা হচ্ছে অর্থাৎ অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার উদ্ভাবিত ও পুনের সিরাম ইনস্টিটিউটে তৈরি কোভিশিল্ড এবং ভারত বায়োটেকের তৈরি কোভ্যাক্সিন দিয়ে এই বিপুল চাহিদা মেটানো মূলত অসম্ভব।
এ কারণেই এখন রাশিয়ার উদ্ভাবিত স্পুটনিক ভি বা আরও নানা বিদেশি টিকাকেও ছাড়পত্র দিচ্ছে ভারত। তবে এই মুহুর্তে সফল একটা অভিযান চালাতে টিকা প্রয়োগের গতি আরও অনেক বাড়াতে হবে বলে মনে করেন রয়্যাল সোসাইটির ফেলো ও ভারতের শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞানী গগনদীপ কাং।
বিবিসিকে ড: গগনদীপ কাং বলেছেন, এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত ভারত কিন্তু জনসংখ্যার মাত্র সাত শতাংশকে এক ডোজ টিকা দিতে পেরেছে। দুটো ডোজই পেয়েছে এক শতাংশের কিছু বেশি মানুষ। এখনও অনেক পথ যাওয়ার বাকি।
তিনি বলেন, এই মুহুর্তে প্রতিদিন আমরা ৩০ লাখ বা তার কিছু বেশি ডোজ টিকা দিচ্ছি। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে দু-তিনগুণ বাড়ানো দরকার। প্রতিদিন অন্তত এক কোটি ডোজ টিকা দিতে পারলে খুব ভালো হয়।
এই লক্ষ্যের ধারেকাছে পৌঁছতে গেলেও ভারতকে বিদেশে টিকা রপ্তানি পুরোপুরি বন্ধ করে দিতে হবে তা নিয়েও বিশেষ সংশয় নেই গগনদীপ কাংয়ের।
অবশ্য এমনিতেই গেল মাস থেকে বিদেশে ভ্যাকসিন পাঠানো বন্ধ রেখেছে ভারত। তবে ওই পদক্ষেপ সাময়িক বলে দাবি করেছে সরকার। ভারত থেকে কেনা ও ভারতের উপহারের টিকা দিয়ে বাংলাদেশে টিকাকরণ শুরু হয় ফেব্রুয়ারিতে।
বিবিসিকে দিল্লির জহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের বিশেষজ্ঞ বিশ্বজিৎ ধর বলেছেন, অদূর ভবিষ্যতে ভারত থেকে আর কোনও টিকা রপ্তানির সম্ভাবনা দেখছেন না তিনি।
তিনি জানান, রপ্তানি এখন আর সম্ভব নয় তা কিন্তু স্পষ্ট। এই মুহুর্তে ভারতে যে চাহিদা তাই সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। এর ওপর এলিজিবিলিটি ক্রাইটেরিয়া আরও শিথিল করা হলে টিকার ঘাটতি অনেকটাই বেড়ে যাবে। ফলে যে টিকা কূটনীতি ভারত শুরু করেছিল তা আর চালিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। আর বিদেশে টিকা পাঠিয়ে বা উপহার দিয়ে যে ভাবমূর্তি তখন ভারত অর্জন করেছিল তাও কিন্তু এখন হুমকির মুখে।
বিশ্বজিৎ ধর আরো বলেন, একটা ইল-কনসিভড বা অপরিকল্পিত চিন্তাভাবনার ভিত্তিতে আমরা যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম তাও এখন স্পষ্ট। ফলে ভারতের ওপর কতটা নির্ভর করা যায়, সেই বিষয়টাও কিন্তু প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
পুনের সিরাম ইনস্টিটিউটে তৈরি হচ্ছে কোভিশিল্ড
ভারতে জানুয়ারিতে ঢাকঢোল পিটিয়ে ভ্যাক্সিন মৈত্রী অভিযান শুরু হয়েছিল তা দ্রুত থমকে যাওয়ার পেছনে কারণ হিসেবে অধ্যাপক ধর মনে করেন, বিশ্বের বৃহত্তম টিকা উৎপাদক সিরাম ইনস্টিটিউটের সামর্থ্য ঠিক কতটা তা নিয়ে হিসেবে অবশ্যই ভুলচুক হয়েছিল।
তার কথায়, সিরাম ইনস্টিটিউট শুরুতে বলেছিল প্রতি মাসে দশ কোটি ডোজ টিকা উৎপাদন করতে পারবে তারা। কিন্তু এখন বুঝতে পারছে সেটা সম্ভব হচ্ছে না। অবশ্য সেই সঙ্গে তারা বলছে, মার্কিন প্রশাসন ডিফেন্স প্রোডাকশন অ্যাক্ট প্রয়োগ করে ভ্যাক্সিন কালচার বা নানা কাঁচামালের রপ্তানি আটকে দিয়েছে। টিকার সব উপাদান যথেষ্ট পরিমাণে আসছে না।
ফলে সিরাম ইনস্টিটিউট যেসব দেশের সঙ্গে টিকা সরবরাহের সমঝোতা করেছে তাদের অপেক্ষা আরও দীর্ঘায়িত হতে যাচ্ছে তা বলাই বাহুল্য। আগস্ট বা সেপ্টেম্বরের আগে ভারত বিদেশে এক ডোজ টিকাও রপ্তানি করতে পারবে না বলে আশঙ্কা করছে দেশটির বিশেষজ্ঞরা।
এসএন