বর্তমান সরকার কৃষি গবেষণাকে সবচেয়ে গুরুত্ব দেয়ায় নতুন করে ৮০ হাজার হেক্টর পতিত জমি চাষাবাদের আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে। আমাদের বহু জমি এখনও পতিত পড়ে আছে। সেই পতিত জমিতে কীভাবে ফসল ফলানো যায় তার জন্য মাটির ওপর গবেষণা চলছে। সেখানে আমরা সাফল্য অর্জন করেছি। বললেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আজ রোববার (২৭ জুন) রাজধানীর ওসমানী মিলনায়তনে দেশের কৃষি খাতের সর্বোচ্চ সম্মাননা ‘বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার’ প্রদান অনুষ্ঠানে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হয়ে তিনি এসব কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারে আসার পর থেকে গবেষণাকেই সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়েছে। আর এতে কৃষি উৎপাদনও বৃদ্ধি পেতে শুরু করে।
সরকারপ্রধান বলেন, গম গবেষণা প্রতিষ্ঠান আমরা গড়ে তুলেছি, চিংড়ি গবেষণা প্রতিষ্ঠান আমরা গড়ে তুলেছি। সাথে সাথে সেগুলো যেন যথাযথভাবে ব্যবহার হতে পারে সে ব্যবস্থা আমরা নিয়েছি। পতিত প্রায় ৮০ হাজার হেক্টর অতিরিক্ত জমি আমরা চাষাবাদের আওতায় নিয়ে আসতে পেরেছি। আমাদের বহু জমি এখনও পতিত পড়ে আছে। সেই পতিত জমিতে কীভাবে ফসল ফলানো যায় তার জন্য মাটির ওপর গবেষণা চলছে। সেখানে আমরা সাফল্য অর্জন করেছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, চরাঞ্চল বা অন্যান্য পতিত জায়গার মাটি গবেষণা করে নানা ধরনের ফসল সেখানে উৎপাদন হচ্ছে। কাজেই যেসব এলাকায় একসময় কোনো ফসলই হতো না, এখন সেখানে ফসল হচ্ছে। কোথাও সবজি হচ্ছে, কোথাও বাদাম বা তরমুজ, ফল, লেবু, তরিতরকারি হচ্ছে।
তিনি বলেন, ২০০৯-এ সরকার গঠন করার পর থেকে আমরা দেশের কৃষি অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করতে আবার গুরুত্ব দিই। আমাদের দেশ যেহেতু কৃষিনির্ভর দেশ। আমাদের অর্থনীতি কৃষির ওপরই নির্ভরশীল।
শেখ হাসিনা বলেন, কৃষিকেই আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে। আর মানুষের মুখের অন্নের ব্যবস্থা করতে হবে। আগে খাদ্যনিরাপত্তা, এটাই হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কথায় বলে পেটে খেলে পিঠে সয়। কাজেই সেভাবেই আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপ নিই।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা অনেক বেশি মূল্য দিয়ে সার ক্রয় করি বা উৎপাদন করি। কিন্তু আমরা কৃষকদের ভর্তুকি দিই। সারের দাম কমিয়ে যেমন ইউরিয়া ১৬ টাকা, টিএসপি ২২ টাকা আমরা ধার্য করে দিয়েছি। কৃষকদের হাতে আমরা তা পৌঁছে দিই।
তিনি আরও বলেন, এ ছাড়াও লবণাক্ত-সহিষ্ণু বীজ, ক্ষরাসহিষ্ণু বীজ, জলমগ্নসহিষ্ণু বীজ গবেষণার মাধ্যমে আমরা একে একে সাফল্য অর্জন করছি। লবণাক্তসহিষ্ণু বীজ এরই মধ্যে বাজারে চলে গেছে। এর ফলে দক্ষিণাঞ্চলে যেখানে লবণপানিতে খাদ্যশস্য নষ্ট হয়, ভবিষ্যতে সেটা আর হবে না। উৎপাদন আরও বৃদ্ধি পাবে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ এখন ডিজিটাল বাংলাদেশ। মোবাইল ফোন সকলের হাতে হাতে। আমরা মোবাইল ফোন ও ডিজিটাল পদ্ধতিতে কৃষি তথ্য যাতে আমাদের কৃষকরা পেতে পারেন বা যারা উৎপাদন করেন তারা পেতে পারেন তার ব্যবস্থা নিয়েছি। তা ছাড়া কৃষি বাতায়ন ও কৃষি কমিউনিটি রেডিও আমরা চালু করেছি। এখানে কৃষির ওপর অনুষ্ঠান হয়। কৃষকের কোনো তথ্য প্রয়োজন হলে তারা কৃষি বাতায়ন থেকে সংগ্রহ করতে পারেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ব্যাংকের মাধ্যমে সরকার সরাসরি কৃষকের কাছে প্রণোদনা পৌঁছে দিচ্ছে। আমরা কৃষি ও পল্লি উন্নয়ন খাতে ব্যাপক বরাদ্দ দিচ্ছি। কৃষকদের আমরা প্রথমে সুযোগ করে দিয়েছি যে মাত্র ১০ টাকায় একজন কৃষক ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে পারেন। সে সুযোগ আমরা সৃষ্টি করি। প্রথম এটা আমরা শুরু করি দেশের সবচেয়ে মঙ্গাপীড়িত এলাকা কুড়িগ্রাম থেকে। সেই সাথে কৃষি উপকরণের যে টাকাগুলো, সেগুলো সরাসরি তাদের কাছে যাতে ব্যাংক অ্যাকাউন্টে চলে যায় সে ব্যবস্থাটা আমরা করে দিই।
শেখ হাসিনা বলেন, প্রায় ২ কোটি ৫ লাখ ৯৯ হাজার ৮৬৯ জন কৃষককে ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ৪১৩ দশমিক ৪৬ কোটি টাকা প্রণোদনা আমরা সরাসরি তাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছি। করোনার সময় দুরবস্থা এ কারণে এটার ওপর আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি।
তিনি বলেন, আমরা যে বিদ্যুৎ সরবরাহ করি সেখানে আমরা প্রায় ২০ শতাংশ ভর্তুকি দিচ্ছি কৃষকদের জন্য। সাথে সাথে কৃষিপণ্য বা কৃষিজাত পণ্য যদি রপ্তানি হয় সেখানেও ২০ শতাংশ বিশেষভাবে প্রণোদনা আমরা দিয়ে যাচ্ছি।
তিনি আরও বলেন, খাদ্যনিরাপত্তার পাশাপাশি পুষ্টিনিরাপত্তা নিশ্চিতেও সরকার জোর দিচ্ছে। প্রায় ৮০ লাখ কৃষককে সবজি, পুষ্টিবাগান ও শস্য বহুমুখীকরণের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে যাতে তাদের পুষ্টিটাও নিশ্চিত হয়। শুধু খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করলে হবে না, পুষ্টিটাও নিশ্চিত করতে হবে, সেদিকে আমরা বিশেষ দৃষ্টি দিচ্ছি। পুষ্টিনিরাপত্তায় ৬টি সিমেট্রিক এরিয়াতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। এক. কৃষি গবেষণা উন্নয়ন, দুই. কৃষি উপকরণ সরবরাহ, তিন. কৃষি সরবরাহ, চার. সেচকাজে পানির সাশ্রয় করা, পাঁচ. জলবায়ু ক্ষতিজনিত প্রভাব মোকাবিলা এবং ছয়. প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি ও মানবসম্পদ উন্নয়ন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সেচকাজে এখন আমরা বিদ্যুৎ যেমন দিচ্ছি, পাশাপাশি সোলার প্যানেলের মাধ্যমে যাতে সেচকাজ চলে সে ব্যবস্থা নিচ্ছি। এতে কৃষক যাতে আরও উৎসাহিত হতে পারেন। কীটনাশকমুক্ত শাকসবজি জোগান দিতে ৪১টি এলাকায় কৃষকের বাজার চালু করা হয়েছে।
তিনি বলেন, আমরা যদি বিদেশে রপ্তানি করতে চাই তাহলে কতগুলো নিয়ম আছে, বাধ্যবাধকতা আছে। আমরা সেগুলো মেনে যাতে উৎপাদন বাড়িয়ে রপ্তানি করতে পারি তার ব্যবস্থা আমরা নিয়েছি।
তিনি বলেন, আমাদের দেশের মাটি এত উন্নত যে একটু গবেষণা করে যেকোনো ফসল উৎপাদন করা যায়। সে ব্যবস্থা আমরা করেছি। গবেষণার ফলে দেশি ফলের উৎপাদনের পাশাপাশি বিদেশি ফল উৎপাদনও বৃদ্ধি পেয়েছে।
অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী সরাসরি উপস্থিত থাকতে না পারায় তার হয়ে মনোনীতদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক। এ বছর কৃষি খাতে অবদান রাখায় ৩২ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে বঙ্গবন্ধু কৃষি পুরস্কার দেয়া হয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পরপরই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে কৃষি উন্নয়নে অনুপ্রেরণা জোগাতে এ পুরস্কার প্রবর্তন করেন। এরই ধারাবাহিকতায় এবারও দেয়া হলো এ পুরস্কার।
পুরস্কারের মধ্যে প্রথম পুরস্কার ৫টি স্বর্ণ, দ্বিতীয় পুরস্কার ৯টি ব্রোঞ্জ ও তৃতীয় পুরস্কার ১৮টি রৌপ্যপদক।
প্রতিবছর সাধারণত বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার দেয়া হয় ১০টি বিষয়ের ওপর বিশেষ অবদানের জন্য। এগুলো হচ্ছে কৃষি গবেষণা অবদান, কৃষি সম্প্রসারণে অবদান, প্রাতিষ্ঠানিক/সমবায়/কৃষক পর্যায়ে উচ্চমানসম্পন্ন বীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ, বিতরণ ও নার্সারি স্থাপন, কৃষি উন্নয়নে জনসচেতনতা বৃদ্ধি, উদ্বুদ্ধকরণ প্রকাশনা ও প্রচারণামূলক কাজ, পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি উদ্ভাবন বা ব্যবহার, কৃষিতে নারীদের অবদান, বাণিজ্যিক ভিত্তিতে খামার স্থাপন, বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বনায়ন, বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি চাষ, বাণিজ্যিক ভিত্তিতে মৎস্য চাষ।