আর্কাইভ থেকে আবহাওয়া

হাড় কাঁপনো শীতে কাবু জনজীবন, যশোরের তাপমাত্রা ৭.৮

এ বছর শীতের প্রকোপ বেড়ে যাওয়াতে সবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু এখন শীত। দেশের জেলা ৬৪টি। এর মধ্যে ২১টিতে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। কিন্তু প্রায় সারাদেশেই মাঝারি থেকে তীব্র শীত অনুভূত হচ্ছে। এক সপ্তাহ ধরে চলছে এই পরিস্থিতি, যা হাড় কাঁপিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি আছে কুয়াশার প্রকোপ।

রাজধানীতে শীতের তীব্রতা কিছুটা কমলেও তা একইভাবে অনুভূত হবে। রাত ও দিনের তাপমাত্রা কিছুটা বাড়তে পারে। সকালে শীতের তীব্রতা সামান্য বেড়ে হয়েছে ১২ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।

সবচেয়ে তীব্র ঠান্ডার মুখোমুখি সীমান্তের জেলা যশোরের জনসাধারণ। সারাদেশের মধ্যে যশোরে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। এ জেলায় আজ সকালে দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৭.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে।

রোববার (৮ জানুয়ারি) সকালে আবহাওয়াবিদ ড. মোহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক এ তথ্য জানান।

তিনি বলেন, আজও রাজধানীতে শীতের তীব্রতা থাকবে। সকালে সামান্য বেড়ে হয়েছে ১২ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবে এর তীব্রতা একইভাবে অনুভূত হবে।

আবহাওয়াবিজ্ঞানী ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক জানান, মোটা দাগে ছয়টি কারণে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।

এগুলো হচ্ছে-সবোচ্চ-সর্বনিম্ন তাপমাত্রার পার্থক্য ১০ ডিগ্রির নিচে নেমে আসা; বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার ব্যাপক এলাকা সূর্যের আলোয় উত্তপ্ত হতে না পারা; উচ্চচাপ বলয়ের প্রভাব, জেড স্ট্রিম বা ঊর্ধ্বাকাশের বায়ু নেমে আসা এবং হিমালয়ের দিক থেকে আসা শীতল বায়ুপ্রবাহ; সূর্যের স্বল্পমেয়াদি কিরণকাল; দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে লঘুচাপের প্রভাব; বাতাসের আর্দ্রতা।

এসব কারণ মিলিয়ে ব্যারোমিটারের পারদ শৈত্যপ্রবাহের পর্যায়ে নেমে না আসা সত্ত্বেও শীতের অনুভূতি অনেক বেশি, যা মাঝারি থেকে তীব্র শীতের অনুভূতি তৈরি করছে। তবে সোমবার (কাল) ধীরে ধীরে এই পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে।

জলবায়ু বিশেষজ্ঞ এবং জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত আন্তঃসরকার প্যানেলের (আইপিসিসি) গবেষক বুয়েটের অধ্যাপক ড. একেএম সাইফুল ইসলাম জানান, পৌষ-মাঘে বাংলাদেশে শীত থাকাটাই স্বাভাবিক। বর্তমান পরিস্থিতির জন্য আবহাওয়াসংক্রান্ত বাস্তবতা বিশেষ করে বঙ্গোপসাগরে বিদ্যমান লঘুচাপের একটা দায় আছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে এর সরাসরি সম্পৃক্ততা নেই। তবে এটা ঠিক যে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বব্যাপী অন্যান্য পরিস্থিতির সঙ্গে আবহাওয়া ও জলবায়ুর চরম ভাবাপন্ন অবস্থা তৈরির সম্পর্ক আছে। এর মানে হচ্ছে, আবহাওয়া চরম বৈরী আচরণ করবে। যখন গরমকাল থাকবে, তখন অসহনীয় গরম পড়বে। অনাবৃষ্টি তৈরি হলে তা চরম খরায় রূপ নেবে।

অতিবৃষ্টি হলে অল্পসময়ে এক-দুই মাসের বৃষ্টি হবে। আর মৃদু শৈত্যপ্রবাহে চরম শীতের অনুভূতি থাকবে। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন পরিস্থিতিতে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে মেলানো যেতে পারে। কিন্তু সরাসরি সম্পর্কিত করা যাচ্ছে না।

আবহাওয়া বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে, তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রির নিচে নামলে এবং ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকলে একে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বলে। এছাড়া ৬ থেকে ৮ ডিগ্রির মধ্যে থাকলে তা মাঝারি আকারের এবং এর নিচে ৪ ডিগ্রি পর্যন্ত নামলে তা তীব্র শৈত্যপ্রবাহে পরিণত হয়। আর ৪ ডিগ্রির নিচে নামলে তা অতি তীব্র শৈত্যপ্রবাহে রূপ নেয়।

অন্যদিকে গরমকালে ঘর শীতল করতে যে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি) ব্যবহার করা হয় তাতে আরামদায়ক পরিস্থিতি অনুভবের জন্য সাধারণত ২৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস ব্যবহার করা হয়। বিদায়ি বছরে বিদ্যুৎ সংকট সৃষ্টির পর সরকারিভাবে এসির তাপমাত্রা ২৬ ডিগ্রিতে ব্যবহারের নির্দেশনা দেয়া হয়।

এর থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ২৪ ডিগ্রিতে তাপমাত্রা নামলেই শীত বা নাতিশীতোষ্ণ অবস্থা অনুভূত হয়। শনিবার দেশে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় চুয়াডাঙ্গায় ৮.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এটা মৃদু শৈত্যপ্রবাহের মধ্যে পড়ে। এছাড়া ১০ ডিগ্রির মধ্যে তাপমাত্রা ছিল ফরিদপুর, মাদারীপুর, কিশোরগঞ্জ, দিনাজপুর, নীলফামারী, পঞ্চগড়, যশোর, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, সাতক্ষীরা ও বরিশাল অঞ্চলে।

অর্থাৎ ওইসব এলাকায় মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের (বিএমডি) মতে, প্রায় সারা দেশে মাঝারি থেকে তীব্র শীতের অনুভূতি আছে। বিশেষ করে দেশের উত্তর, উত্তর-পশ্চিম, মধ্য ও দক্ষিণাঞ্চলে এই পরিস্থিতি বেশি। অর্থাৎ এসব অঞ্চলে তাপমাত্রা ৮.৪ থেকে ১২.৩ ডিগ্রির মধ্যে থাকলেও এর অনুভূতি আছে এলাকাভেদে ৪ থেকে ৮ ডিগ্রির মধ্যে।

অন্যদিকে শনিবার দেশে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল বঙ্গোপসাগরের পার কক্সবাজারের টেকনাফে ২৬.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ২৬ তাপমাত্রা যেহেতু গরম নয় বা ২৪ ডিগ্রি শীত অনুভবের জন্য যথেষ্ট, তাই দেখা যাচ্ছে, সর্বোচ্চ তাপমাত্রাও গরম তৈরির জন্য যথেষ্ট নয়।

তবে সুখবর হচ্ছে, যেহেতু সাগরপারের এলাকায় তাপমাত্রা বাড়ছে, তাই ধীরে বঙ্গোপসাগরের দিক থেকে উষ্ণ আর্দ্রতা মিশ্রিত গরম বায়ু সারা দেশে বিস্তার লাভ করতে পারে। এর ফলে সোমবার থেকে তাপমাত্রা বাড়তে শুরু করবে। এরপর কয়েকদিনের মধ্যে মাঝারি থেকে তীব্র শীতের অনুভূতি কমতে পারে।

যে ৬টি কারণে বর্তমানে মৃদু শৈত্যপ্রবাহেও তীব্র শীতের অনুভূতি তার মধ্যে প্রথমেই আসে সবোচ্চ-সর্বনিম্ন তাপমাত্রার পার্থক্য ১০ ডিগ্রির কম। বরিশাল বিভাগের খেপুপাড়ায় শনিবার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ২৫.২ আর সর্বোচ্চ ১২.৩ ডিগ্রি। এখানে পার্থক্য প্রায় ১৩ ডিগ্রি।

অর্থাৎ ওই এলাকায় শীতের অনুভূতি কম বা হাড় কাঁপানো অবস্থায় নেই। কিন্তু ঢাকায় এদিন সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ১৮.৮ আর সর্বনিম্ন ১১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। পার্থক্য ৭ ডিগ্রির একটু বেশি। অন্যদিকে শনিবার ঢাকায় সারাদিনই সূর্যের মুখ দেখা যায়নি। দুপুর দেড়টার দিকেও হালকা কুয়াশা ছিল রাজধানীতে। অন্যদিকে শীতকালে এমনিতেই উত্তর মেরুর দেশগুলোয় সূর্যের কিরণকাল থাকে অল্প।

বাংলাদেশের মতো দেশে ভূপৃষ্ঠ উষ্ণ করার মতো কিরণ পাওয়া যায় সর্বোচ্চ ৬ ঘণ্টা। কিন্তু এক সপ্তাহ ধরে সেই সুযোগ ১ থেকে ২ ঘণ্টার বেশি পাওয়া যাচ্ছে না। শুধু বাংলাদেশ নয়, পাকিস্তানের মরু এলাকাসহ ভারতের হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, দিল্লি, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, বিহার, পশ্চিমবঙ্গসহ হিমালয়ের পাদদেশীয় এলাকারই একই অবস্থা। দক্ষিণ এশিয়ার এই ব্যাপক এলাকা সূর্যের আলোয় উত্তপ্ত হতে পারছে না।

এ বাস্তবতায় পরিস্থিতি আরও অবনতি ঘটিয়েছে হিমালয়ের দিক থেকে আসা শীতল বায়ু। আছে উচ্চচাপ বলয়ের প্রভাব। জেড স্ট্রিম বা ঊর্ধ্বাকাশের বায়ু শীতল। সেটিও নেমে এসেছে। অন্যদিকে দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে মৌসুমের স্বাভাবিক লঘুচাপ অবস্থান করছে। সাধারণত সাগরের কোনো অংশের পানির উষ্ণতা ২৬ ডিগ্রি পার করলে ওই এলাকায় লঘুচাপ তৈরি হয়।

ভারতের আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ এলাকা থেকে দক্ষিণদিকে বিষুবরেখা বা জিরো ডিগ্রি লাইন বরাবর এলাকাকে দক্ষিণ বঙ্গোপসাগর বলা হয়। ওই এলাকায় লঘুচাপ অবস্থান করায় আশপাশের আর্দ্রতা (লঘুচাপের) কেন্দ্রের দিকে চলে যাচ্ছে। আর এই সুযোগে শূন্যস্থানে হিমালয়ের দিক থেকে আসা উত্তর বা উত্তর-পূর্বদিকের শীতল বায়ু স্থলভাগে প্রভাব বিস্তার করছে। আর এই শীতল বাতাসে আর্দ্রতা অনেক বেশি। তাই শীতের অনুভূতিও বেশি, যা অল্পতেই তীব্র শীতের অনুভূতি তৈরি করছে।

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন