আর্কাইভ থেকে বাংলাদেশ

গাইবান্ধা জেনারেল হাসপাতালে দালাল সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি রোগিরা

গাইবান্ধা জেনারেল হাসপাতালে দালাল সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি রোগিরা
আইনের তোয়াক্কা না করে গাইবান্ধা জেনারেল হাসপাতালের বাউন্ডারি ওয়াল ঘেঁষে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে আল মদিনা, মাইশা, আবির ডায়াগনস্ট্রিক সেন্টার, আইডিয়াল ডায়াগনস্টিক, ইসলাম ডায়াগনস্টিক সেন্টারসহ বেশকিছু ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিক। হাসপাতালের কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠা ডায়াগনস্টিক সেন্টারসহ ওষুধের দোকানের মালিকরা দালালদের দিয়ে হাসপাতালের রোগীদের কৌশলে ফুসলিয়ে নিয়ে যায়। ফলে রোগীর পরিক্ষা-নিরীক্ষার অতিরিক্ত ফি আদায়সহ তাদের স্বজনদের চড়া দামে ওষুধ কিনতে হয়। সরেজমিনে দেখা যায়, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নিয়োগপ্রাপ্ত মহিলা ও পুরুষ দালালরা কেউ থাকেন ডাক্তারের রুমে, কেউ থাকেন রোগী খোঁজেন ঘোরাফেরার মধ্যে, আবার অন্যজন ব্যস্ত থাকেন রোগীদের নিয়ে নির্ধারিত প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা ওষুধ বিক্রিতে। এই দালাল চক্রের মধ্যে নারীসহ প্রায় ২৫ থেকে ৩০ জন প্রতিনিয়ত হাসপাতালে আসা বিভিন্ন রোগীকে হয়রানি করে। দালাল চক্রের কাছের জিম্মি হাসাপাতাল কৃর্তপক্ষ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সরকারি হাসপাতালের এক ডাক্তার বলেন, রোগিদের স্বাভাবিক জীবনকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত, দুর্দশাগ্রস্ত এবং অসহায় করে তোলে। মানুষকে তাদের মৌলিক অধিকার সু-চিকিৎসা সঠিকভাবে নিশ্চিত করা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব। কিন্তু দেখা যায় হাসপাতালে গাইনি, মেজর ও মাইনর অপারেশন ও প্যাথলজি পরীক্ষা, এক্স-রে, ইসিজি, যক্ষ্মা ও কুষ্ঠসহ প্রায় সব পরীক্ষা এবং চিকিৎসা ব্যবস্থা থাকলেও কর্তব্যরত ডাক্তার অসহায় রোগীদের অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা দিয়ে দালালদের হাতে তুলে দেন। বৃহস্পতিবার সকাল  সাড়ে ১১টা। হাসপাতালের মুল গেটে প্রবেশ করতেই দেখা মেলে এক নারী রোগির। তিনি সদর উপজেলার তুলসীঘাট এলাকার শিবপুর গ্রাম থেকে চিকিৎসা নিতে এসেছেন। হাসপাতালের বাইরে বের হচ্ছিলেন ওই রোগি। তার সঙ্গে রয়েছেন এক নারী দালাল চক্র। বিষয়টি আগে থেকেই জানা ছিল যে হাসপাতালে দালাল সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি রোগিরা। রোগিদের ভাগিয়ে অন্যস্থানে নিয়ে পরিক্ষা-নিরীক্ষা করান এই সিন্ডিকেট। প্রথমে ওই রোগিকে তার সঙ্গে থাকা নারীর পরিচয় জানতে চাওয়া হয়। এতেই ওই নারী যেন চমকে উঠলেন। প্রথমে তাকে নাম জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি অপারগতা প্রকাশ করেন। কথা বলার একপর্যায়ে সে তার নাম শ্রী শান্তনা রানী বলে জানান। রোগিকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি থমকে থমকে বলেন, এখন তো হাসপাতালে আল্ট্রাসনোগ্রাম করা হয়না। তাই রোগিকে আল্ট্রাসনোগ্রাম করার জন্য গাইবান্ধা ডিজিটাল ল্যাবে নিয়ে যাচ্ছি। হাসপাতালের আউট ডোরে যেতেই দেখা মেলে আরেক দালাল সিন্ডিকেটের সঙ্গে। তার নাম রত্না রানী। পাশে দাঁড়িয়ে আছে এক নারী রোগি। রত্ন রানীকে নাম জিজ্ঞাসা করতেই বললেন হাসপাতালে তার রোগি ভর্তি আছে। রোগিকে দেখতে যেতে চাইলে তিনি থমকে যান। একপর্যায়ে জানালেন, সাজিদ ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চাকরী করেন তিনি। কথা শেষ না হতেই সেখান থেকে তারাহুরো করে সটকে পড়েন রত্না রানী। পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায় এ নামে আশ-পাশে কোন ডায়াগনস্টিক সেন্টার নেই। হাসপাতালের ভেতরে জরুরী বিভাগে প্রবেশ করতেই রোগিদের ভিড় চোখে পড়ে। সেখানে রোগিদের চিকিৎসা দিচ্ছেন সারওয়ার হোসেন তমাল নামে একজন ডাক্তার। পাশে ব্রিজ রোডস্থ এলাকার মিজান নামে বহিরাগত এক যুবক ওই ডাক্তারকে স্লিপ সরবরাহ করতে দেখা যায়। ওই হাসপাতালের স্টাফ কিনা জানতে চাইলে তিনি তার বিষয়ে ডা. সারওয়ার হোসেন তমালের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। তিনি প্রতিবেদকের সঙ্গে ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, আমি জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সদস্য। কিছু লেখে দেখেন পরে এর মজা পাবেন। পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মদিনা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিক সুমন মিয়ার শ্যালক এই মিজান। মিজান জরুরী বিভাগে থাকেন রোগী কালেকশনের জন্য। হাসপাতালের জরুরী বিভাগে রোগীকে কোন পরিক্ষা নিরিক্ষা দিলেই তিনি আল-মদিনা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পাঠান। এ ব্যাপারে ডা. সারওয়ার হোসেন তমাল বলেন, মিজান একজন স্বেচ্ছাসেবী। সে আমাদেরকে সহযোগিতা করে থাকেন। মিজান কোনো সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত আছে কিনা আমার জানা নেই। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে বলুন। হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা সদর উপজেলার বোয়ালিয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা খলিলুর রহমান (৫২) বলেন, হাসপাতালে শুধুমাত্র চিকিৎসাপত্র দেয়া হয়। কোন পরিক্ষা-নিরীক্ষা করার প্রয়োজন হলে হাসপাতালে পরিক্ষা না করে বাইরে যেতে বলেন। সেখানে ওই চক্রের সঙ্গে হাসপাতালের লোকজনের যোগসাজশ রয়েছে। এছাড়া হাসপাতালে কোন ওষুধ দেয়া হয়না। ফলে চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। হাসপাতালে দালাল সিন্ডিকেট থাকার কথা স্বীকার করে গাইবান্ধা সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক (উপ-পরিচালক) ডা. মো. মাহবুব হোসেন বলেন, হাসপাতালে শুধুমাত্র এক্স-রে মেশিন ছাড়া সকল চিকিৎসা সরঞ্জামাদি সচল রয়েছে। চেষ্টা করছি আমরা এই সিন্ডিকেটে জড়িতদের আটক করার জন্য। এতে যদি হাসপাতালের স্টাফও জড়িত থাকে তাদেরকে আইনে আওতায় আনা হবে। এক্ষেত্রে আপনাদেরও ভূমিকা রয়েছে আমাদের সহযোগিতা করার। এ বিষয়ে রংপুর বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহা পরিচালক ডা. এবিএম আবু হানিফ বলেন, এটা অবশ্যই আমাদের কাম্য নয়। দালালমুক্ত হাসপাতালের লক্ষে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। জড়িতদের আটক করে পুলিশে সোপর্দ করার জন্য হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ককে বলা হয়েছে। সেবা নিতে এসে রোগিরা ক্যানো হয়রানি হচ্ছে বিষয়টি খতিয়ে দেখছি।

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন গাইবান্ধা | জেনারেল | হাসপাতালে | দালাল | সিন্ডিকেটের | কাছে | জিম্মি | রোগিরা