২০০২ সালে এসএসসি পাসের পর ঢাকায় আসেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আবু হানিফ তুষার ওরফে হানিফ মিয়া। ধানমন্ডি ও নাখালপাড়া এলাকায় বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে পড়েন। বিভিন্ন সময় তার নামে হওয়া মামলায় জেল খেটেছেন। জেল থেকে বের হয়ে শুরু করেন প্রতারণার ব্যবসা।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এক রাজনৈতিক নেতার সান্নিধ্যে শুরু হয় তার প্রতারণার পথচলা। সেই ব্যক্তিকে পুঁজি করে বিভিন্ন সভা সেমিনারে গিয়ে গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে পরিচিত হতেন। তাদের সাথে ছবি তুলে সেগুলো ফেসবুকে আপলোড করতেন। কখনো বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, আবার কখনো প্রধানমন্ত্রীর নিকট আত্মীয়ের পরিচয় দিতেন তিনি। সেই পরিচয়ের সূত্র ধরে বিভিন্ন জনকে চাকরি, প্রমোশন এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন পাইয়ে দেয়ার কথা বলে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন হানিফ। তার এ প্রতারণা চলছিল ২০১৫ সাল থেকে। কিন্তু বিষয়টি জানতো না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এভাবে হানিফ গেলো ৮ বছরে শুধু প্রতারণা করে নিজের ব্যক্তিগত দামি গাড়ি, বাড়ি ও নিজের এলাকায় ২০ বিঘা জমি কিনেছেন।
সম্প্রতি আওয়ামী লীগের এক রাজনৈতিক নেতাকে সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন পাইয়ে দেয়ার কথা বলে ২০০ কোটি টাকা দাবি করেন হানিফ। এরপর সেই নেতা র্যাবের কাছে অভিযোগ দিলে তদন্ত শুরু হয়। এতে বেরিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য।
মঙ্গলবার (১৭ অক্টোবর) রাজধানীর বসুন্ধরা এলাকা থেকে প্রতারক এই হানিফকে গ্রেপ্তারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের এসব তথ্য পেয়েছে র্যাব।
বুধবার (১৮ অক্টোবর) দুপুরের রাজধানীতে কারওয়ান বাজার মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
তিনি বলেন, হানিফ ২০১৫ সালের দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এক রাজনৈতিক নেতার ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করেন। কিন্তু এর বিনিময়ে তিনি কোনো বেতন নিতেন না। বিভিন্ন সভা-সেমিনারে আসা গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সাথে পরিচয় হতেন এবং তাদের সাথে ছবি তুলতেন। পরে এসব ছবি তিনি তার ফেসবুকে আপলোড করতেন। হানিফ শুধু দেশে নয়, পাশের দেশে গিয়েও সেখানকার গণমান্য ব্যক্তিদের সাথে ছবি তুলতেন। তবে তিনি কারো সাথে পরিচয় হওয়ার আগে প্রধানমন্ত্রীর নিকট আত্মীয়, বঙ্গবন্ধু পরিবারের সাথে তার ভালো সম্পর্ক রয়েছে এসব বলে নিজেকে জাহির করতেন। তার সাথে পরিচয় হওয়া ব্যক্তিরা সহজে সেগুলো বিশ্বাস করতেন। সেসব ব্যক্তির সাথে পরিচয় হওয়ার পর তিনি তাদের অফিসে গিয়ে সম্পর্ক করতেন।
২০০ কোটি টাকার প্রতারণা!
হানিফ বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিকে টার্গেট করতেন। তাদের এমপির মনোনয়ন পাইয়ে দেয়ার কথা বলে ২০০ কোটি টাকা করে দাবি করতেন। এমন ১০ থেকে ১২ জনের সাথে তার সম্প্রতি কথা হয়েছে। যা হানিফের মোবাইল মেসেজের সূত্র ধরে এসব তথ্য পেয়েছে র্যাব।
তবে হানিফের দাবি, তিনি কারো কাছ থেকে টাকা নেননি। হানিফ যে ব্যক্তির হাত ধরে বিভিন্ন ব্যক্তির সাথে পরিচয় হতেন সেই রাজনৈতিক ব্যক্তিও তার মাধ্যমে মনোনয়ন পেতে দ্বারস্থ হয়েছিলেন। সেই রাজনৈতিক ব্যক্তির কাছেও তিনি ২০০ কোটি টাকা দাবি করেছেন। হানিফ আগামী নির্বাচনের জন্য জেলাভিত্তিক আওয়ামী লীগ নেতাদের টার্গেট করতেন। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাইয়ে দেয়ার কথা বলে তাদের ফোন নম্বর, নাম ও ঠিকানা সংগ্রহ করে রাখতেন।
প্রতারণার টাকায় গাড়ি-বাড়ি সম্পত্তি!
র্যাবের মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল-মঈন বলেন, হানিফ আমাদের কাছে প্রাথমিকভাবে স্বীকার করেছে তিনি এখন পর্যন্ত পাঁচ কোটি টাকার বেশি প্রতারণা করেছেন। প্রতারণার মাধ্যমে তিনি সেই টাকা দিয়ে ৫-৭টি বাস কেনেন। তবে তিনি এসব বাস বিভিন্ন জনের কাছে ভাড়া দিয়ে রেখেছেন। এছাড়াও তার দামি গাড়ি, বাড়ি ও ২০ বিঘা জমি রয়েছে। এসব সম্পত্তির মূল্য তার প্রতারণার টাকায় অর্জিত আয়ের চেয়েও অনেক বেশি।
পদোন্নতি চাকরির নামে প্রতারণা!
তিনি আরও জানান, হানিফ শুধু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের সাথে প্রতারণা করেননি, বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তাদের পদোন্নতির প্রলোভন দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। তবে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ব্যক্তির সাথে তার পরিচয় থাকার সুবাদে তিনি কয়েকজনকে চাকরি দিতে সক্ষম হয়েছেন বলে দাবি করেছেন। তবে শতশত মানুষ তার কাছে এসে চাকরি ও পদোন্নতির লোভে পড়ে প্রতারিত হয়েছেন এবং তিনি তাদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন বলে স্বীকার করেছেন।
হানিফ কারো সাথে প্রতারণার টার্গেট করলে তার সাথে দামি হোটেলে দেখা করতেন। এজন্য তিনি সেখানে দামি গাড়ি ভাড়া করে যেতেন। এভাবে গত কয়েক বছরে হানিফ শতশত ব্যক্তির সাথে প্রতারণা করেছেন বলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন।