ঊনবিংশ শতাব্দীর অন্যতম বাঙালি কবি ও নাট্যকার তথা বাংলার নবজাগরণ সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা, যিনি ‘মধুকবি’ নামেও খ্যাত; অমিত্রাক্ষর ছন্দের (সনেট) জনক মাইকেল মধুসূদন দত্তের আজ ২০০তম জন্মবার্ষিকী।
কবির জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে প্রতিবছরের মতো এবারও তার জন্মভূমি যশোরের কেশবপুরের সাগরদাঁড়িতে ৯ দিনব্যাপী মধুমেলার আয়োজন করা হয়েছে। গেলো ১৯ জানুয়ারি মধুমেলার উদ্বোধন করা হয়। মেলায় প্রতিদিন দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত মধুমঞ্চে চলছে আলোচনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নাটক ও যাত্রাপালা। কবির ২০০তম জন্মবার্ষিকী ঘিরে মধুপ্রেমীদের এবার আগ্রহ তুঙ্গে। দেশি-বিদেশি পর্যটকসহ প্রচুর দর্শনার্থী মেলায় আসছেন।
১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি কাটিপাড়া নানাবাড়িতে জন্ম নেন মধুসূদন দত্ত। মা জমিদার গৌরীচরণ ঘোষের কন্যা জাহ্নবী দেবী ও বাবা জমিদার রাজনারায়ণ দত্ত। ছোটবেলাতেই বাংলার পাশাপাশি ফারসি শিখতেন পার্শ্ববর্তী শেখপুরা গ্রামের এক মৌলভির কাছে। ১৮৭৩ থেকে ১৮৪১ সাল পর্যন্ত হিন্দু কলেজে ইংরেজি ও ফারসি অধ্যয়ন করেন। ১৮৪৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি মধুসূদন খ্রীষ্টধর্মে দীক্ষিত হন এবং নামের সঙ্গে মাইকেল যুক্ত করেন। সে সময় থেকে শুরু করেন ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য রচনা। হিন্দু কলেজ ত্যাগ করে শিবপুরে বিশপস্ কলেজে ভর্তি হন এবং চার বছর সেখানে থেকে গ্রিক, লাতিন, ফরাসি, হিব্রু প্রভৃতি ভাষা আয়ত্ত করেন।
কিছুকাল পর মাদ্রাজ থেকে কলকাতায় ফিরে দেখেন মা-বাবা মারা গেছেন এবং তাদের বহু সম্পত্তি দখল হয়ে গেছে। অগত্যা মধুকবি পুলিশ আদালতে সামান্য কেরানির চাকরি নেন। জীবনের দ্বিতীয় পর্বে মধুসূদন আকৃষ্ট হন মাতৃভাষার প্রতি। এই সময়ে তিনি বাংলায় নাটক, প্রহসন ও কাব্য রচনা করেন। মাইকেল মধুসূদন বাংলা ভাষায় সনেট ও অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তক। তার সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি রামায়ণের উপাখ্যান অবলম্বনে রচিত মহাকাব্য ‘মেঘনাদ বধ কাব্য’। জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে ফ্রান্সের ভার্সাই নগরে বসে লেখেন ‘কপোতাক্ষ নদ’ এবং ‘বঙ্গভাষা’র মতো বিখ্যাত কবিতা। বাবা রাজনারায়ণ দত্তের বিশাল জমিদারি থেকে বঞ্চিত হয়ে একপর্যায়ে কপর্দকশূন্য অবস্থায় কলকাতায় ১৮৭৩ সালের ২৯ জুন মৃত্যুবরণ করেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত।
মহাকবির ২০০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে প্রতিবছরের মতো এবারও ‘মধুমেলা’ আয়োজন করেছে যশোর জেলা প্রশাসন। গত ১৯ জানুয়ারি মেলার উদ্বোধন হয়, শেষ হবে আগামী ২৭ জানুয়ারি।
শতবর্ষী এ মেলা উপলক্ষে সাগরদাঁড়িকে সাজানো হয়েছে বর্ণিল সাজে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের লাখ লাখ মধুভক্তের উপস্থিতিতে এবারও মুখরিত হয়ে উঠেছে কপোতাক্ষ নদ পার। সাগরদাঁড়ির মধুমঞ্চে কবিকে ঘিরে আলোচনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি প্যান্ডেলে সার্কাস, জাদু প্রদর্শনী ও মৃত্যুকূপের আয়োজন করা হয়েছে। সেই সঙ্গে নানা ধরনের জিনিসপত্র ও মিষ্টির পসরা নিয়ে বসেছেন দোকানিরা।
গ্রামের প্রবীণ নজরুল শেখ স্মৃতিতে ভেসে বলেন, ‘মেলা থেকে আগে লেইস ফিতা, আলতা, সুগন্ধি তেল, পাটের তৈরি শিকি (শিকে) কিনতাম। সময় বদলেছে, তারপরও মেলায় আসি।’
সাগরদাঁড়ির আলোকচিত্র শিল্পী মুফতি তাহেরুজ্জামান তাছু বলেন, ‘মধুমেলা উপভোগ করার জন্য ইতোমধ্যে সাগরদাঁড়ি এলাকাসহ চারপাশের গ্রামে গ্রামে আত্মীয়-স্বজন আসতে শুরু করেছে। অনেকেই মেয়ে-জামাই, বন্ধু-বান্ধবসহ অতিথিদের দাওয়াতও দিয়েছেন। প্রত্যেক বাড়িতে উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে। এবারের মেলায় লাখো দর্শনার্থী ও মধুপ্রেমীদের সমাগম ঘটবে।’
মধুপল্লীর মো. হাসানুজ্জামান বলেন, ‘মধুমেলা উপলক্ষে মধুপল্লী সুন্দরভাবে সাজানো হয়েছে। দর্শনার্থীরা মধুপল্লীতে কবির ভাস্কর্য, প্রসূতিস্থল, কাছারিবাড়ি, স্মৃতি ঘুরে দেখছেন দশনাথীরা।’
মধুসূদন একাডেমির পরিচালক ও গবেষক খসরু পারভেজ বলেন, ‘আশির দশক থেকে মধুমেলা শুরু হয়েছে। প্রথম দিকে মেলায় সাহিত্যবিষয়ক আলোচনা ও কুটিরশিল্পের পসরা বসত। মেলার ব্যাপ্তি বাড়ায় সাহিত্যবিষয়ক আলোচনার পাশাপাশি বর্তমানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ মেলা প্রাঙ্গণে বিভিন্ন দোকানপাটের পসরা বসে।’